বৃহস্পতিবার, 9 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

পাঠ্যবই ছাপায় এনসিটিবির কড়াকড়ি, ‘বাধ্যতামূলক’ ছাপাখানার নাম


স্টাফ রিপোর্টার : নতুন শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ছাপানো পাঠ্যবইয়ের মান নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২০২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথমবারের মতো ছাপানো বইয়ের প্রতিটি ফর্মায় বাধ্যতামূলকভাবে লেখা থাকবে সংশ্লিষ্ট মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম। ফলে বই বিতরণের পর কোনো গুণগত সমস্যা ধরা পড়লে দায়ী প্রতিষ্ঠান সহজে শনাক্ত করা যাবে। একই সঙ্গে কাগজ ও ছাপার মান বাড়াতেও আনা হয়েছে নানা পরিবর্তন। এছাড়া, দ্বৈত ল্যাবে কাগজ পরীক্ষাসহ প্রতিটি প্রেসে বসানো হবে সিসিটিভি ক্যামেরা, যা ২৪ ঘণ্টা মুদ্রণ প্রক্রিয়া সরাসরি পর্যবেক্ষণ করবে।


এনসিটিবি সূত্র বলছে, এমন উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে পূর্বের অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে, কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান বই ছাপার সময় ‘ইনার চেঞ্জ’ নামে একটি অনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করত। এর অর্থ, তারা নিজেদের মানসম্মত কাগজ বা ছাপার বই ব্যবহার না করে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে মানহীন বা পুরোনো বই সংগ্রহ করত। এরপর সেই বইয়ের উপরের মলাটে বা পরিচিত স্থানে শুধু নিজেদের নাম ছাপিয়ে নতুন বই হিসেবে বাজারে সরবরাহ করত। ফলে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাত নিম্নমানের বই, যা শিক্ষার গুণগত মান ও শেখার অভিজ্ঞতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলত। একই সঙ্গে, এই ধরনের অনিয়ম একদিকে যেমন বইয়ের গুণগত মান যাচাই কঠিন করে তুলত, অন্যদিকে দায়ী প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে যেত।


এই অনিয়ম রুখতেই এনসিটিবি’র নতুন পদক্ষেপে প্রতিটি ফর্মায় প্রিন্টারের নাম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে কেউ আর ‘ইনার চেঞ্জ’ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে না। বই হাতে পেলে কিংবা বিতরণের পর যে কোনো প্রশ্ন উঠলেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহজেই দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করতে পারবে।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু মুদ্রণের মান নিয়ন্ত্রণই নয় বরং পাঠ্যবইয়ের নিরাপত্তা ও শিক্ষার্থীদের চোখের স্বাস্থ্যের দিকটিও নজরে রাখা হয়েছে। এজন্য এবার বিশেষভাবে চক্ষুবিজ্ঞানীদের পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত করে বইয়ের কাগজ ও ছাপার প্রক্রিয়া পরীক্ষা করা হয়েছে। বোর্ডের বিশেষজ্ঞ কমিটি, যেখানে কাগজ বিশেষজ্ঞ ও চক্ষুবিজ্ঞানীরা ছিলেন, তারা একযোগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত করেছেন যে ব্যবহৃত কাগজ ও ছাপার রঙ শিক্ষার্থীদের চোখে কোনো প্রকার অস্বস্তি বা ক্ষতি করবে না। বইয়ের উজ্জ্বলতা, কাগজের ঘনত্ব ও প্রাকৃতিক পাল্পের ব্যবহার এমনভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে, যেন দীর্ঘ সময় ধরে পড়লেও চোখে আরামবোধ হয় এবং শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আরামদায়ক পরিবেশ পায়। সেজন্য এবার কাগজের মানেও আনা হয়েছে বড় পরিবর্তন। আগে পাঠ্যবই তৈরিতে ব্যবহৃত কাগজের ওজন ছিল ৮২ জিএসএম (গ্রাম পার স্কয়ার মিটার), এবার তা বাড়িয়ে ৮৫ জিএসএম করা হয়েছে। এতে কাগজ হবে আরও ঘন, টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী। একইভাবে, কাগজের উজ্জ্বলতা সূচক বা ব্রাইটনেস বাড়ানো হয়েছে।


তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার কাগজের বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬ থেকে ২০ করা হয়েছে। ফলে কাগজের দৃঢ়তা ও ঘনত্ব বেড়েছে। এতে বই দীর্ঘ সময় ব্যবহার করা যাবে, সহজে ছেঁড়া যাবে না। শিক্ষার্থীরা পড়ার সময় কাগজের অতিরিক্ত নমনীয়তা বা দুর্বলতার কারণে বিরক্ত হবে না। বরং লেখার ছাপ স্পষ্ট ও চোখে আরামদায়ক একটি ভাব থাকবে। এছাড়া, কাগজে আগে ব্যবহৃত হতো কৃত্রিম উজ্জ্বলকরণ বা অপটিক্যাল ব্রাইটনার। এবার এনসিটিবি পুরোপুরি এই কৃত্রিম উপাদান বাদ দিয়েছে। এবার ব্যবহার করা হচ্ছে ১০০ শতাংশ প্রাকৃতিক পাল্প।

 

অন্যদিকে, এবার প্রতিটি প্রেসে বসানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এর মাধ্যমে এনসিটিবি মুদ্রণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। একই সঙ্গে পরিদর্শন সংস্থাগুলোর (ইনস্পেকশন এজেন্সি) ওপর কড়া শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যাতে কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান এসব সংস্থাকে প্রভাবিত বা ‘পকেটবন্দি’ করতে না পারে। তদুপরি, ইআরসি (এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট) সংক্রান্ত নিয়মেও যোগ করা হয়েছে নতুন শর্ত, যাতে মানহীন প্রতিষ্ঠানগুলো বই ছাপার সুযোগ না পায়।


এসব বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, “প্রতি বছর বইয়ের মান বাড়াতে আমরা নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। নিম্নমানের বই বিতরণের অভিযোগ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, কিন্তু বাস্তবে আমরা ক্রমাগত মানোন্নয়নের পথে কাজ করে যাচ্ছি। গত বছর কিছু বইয়ে সমস্যা থাকলেও এ বছর আমরা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।”

তিনি বলেন, “এবার কাগজের মান নিশ্চিত করতে আমরা কয়েকটি পরিবর্তন এনেছি। আগে বাস্টিং ফ্যাক্টর ছিল ১৬, সেটি বাড়িয়ে এখন ২০ করা হয়েছে। ফলে কাগজ আরও শক্ত হয়েছে এবং সহজে ছেঁড়ার সমস্যা থাকবে না। পাশাপাশি, কাগজে আগে কৃত্রিম উজ্জ্বলতা (অপটিক্যাল ব্রাইটনিং) ব্যবহার করা হতো, যা চোখের জন্য ক্ষতিকর। এবার আমরা সেটি পুরোপুরি বাদ দিয়েছি। এখন যে কাগজ ব্যবহার হবে, সেটি ১০০ শতাংশ প্রাকৃতিক পাল্প থেকে তৈরি। ফলে শিক্ষার্থীদের চোখের ক্ষতির ঝুঁকি কমবে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কাগজবিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও এনসিটিবি’র প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটি পর্যালোচনা করে মতামত দিয়েছে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”


অধ্যাপক রিয়াদ জানান, মনিটরিং প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন এসেছে। আগে শুধুমাত্র শারীরিকভাবে (ফিজিক্যাল) কাগজ পরীক্ষা করা হতো। এবার তিন ধাপে মনিটরিং করা হচ্ছে। সরেজমিন পরিদর্শন, অনলাইনে ডাটা ট্র্যাকিং এবং সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি নজরদারি। ফলে যে কোনো প্রেসের কার্যক্রম রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।

এছাড়া, ইন্সপেকশন এজেন্টদের ওপরও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আগে অনেক সময় দেখা যেত খারাপ কাগজও ভালো রিপোর্ট দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হতো। এবার প্রতিটি প্রেস ও পেপার মিলের কাগজ দ্বৈতভাবে পরীক্ষা করা হবে। প্রথমে তাদের নিজস্ব ল্যাবে, তারপর এনসিটিবি’র ল্যাবে। প্রয়োজনে নমুনা বিশেষায়িত গবেষণাগারেও পাঠানো হবে। আরেকটি নতুন উদ্যোগ হলো— প্রতিটি ফর্মায় সংশ্লিষ্ট প্রেসের নাম ছাপানো থাকবে। ফলে কোন প্রেসে কোন বই ছাপা হলো, তা সহজে শনাক্ত করা যাবে। অতীতে অনেক প্রেস অন্য কোথাও বই ছেপে নিজেদের নাম লাগিয়ে দিত। এবার সেই সুযোগ থাকছে না।”


তবে, এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো একজোট হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা বৈঠক করে সমঝোতার মাধ্যমে ‘সিন্ডিকেট দর’ নির্ধারণ করছে। এতে প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ায় সরকারি অর্থে বই ছাপাতে লাগছে বাড়তি খরচ। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই সিন্ডিকেটের কারণে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হতে পারে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মান বাড়ানোর পদক্ষেপের ফলে বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ পড়তে পারে।


প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে ৩০ কোটির বেশি বই ছাপাতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৩০ কোটি ফর্মার প্রতিটিতে গত বছরের তুলনায় ৩৯ পয়সা বেশি, আর মাধ্যমিকে ৪৪৫ কোটি ফর্মায় ৫০ পয়সা বেশি ব্যয় হচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পার্থক্যের পুরো অংশই অতিরিক্ত ব্যয়। যদিও ২০২১–২০২৩ সালে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে সরকারের মোট সাশ্রয় হয়েছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তখন প্রতি লটের বিপরীতে সাত-আটটি দরপত্র জমা পড়ত, যা পাঠ্যবই ছাপায় নজিরবিহীন আর্থিক সাশ্রয় এনেছিল।


বিষয়টি নিয়ে সিন্ডিকেটভুক্ত এক প্রেসমালিক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দরপত্রের দাম বাড়ানো শুধু সিন্ডিকেটের কারণে নয়, নতুন মানদণ্ড মেনে চলতে গিয়ে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। ভার্জিন পাল্পের কাগজ, উচ্চ জিএসএম, ব্রাইটনেস বাড়ানো— এসবের জন্য খরচ বেড়েছে। তবে, প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ায় সরকারের ব্যয় যে বেড়েছে, সেটিও অস্বীকার করছি না।”

অন্যদিকে, প্রেসমালিকদের বাড়তি কোনো চাপ রয়েছে কি না— জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবি’র এক কর্মকর্তা বলেন, “মান নিয়ন্ত্রণের এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে প্রিন্টার অ্যাসোসিয়েশন, পেপার মিলমালিক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে চতুর্পক্ষীয় সভা করা হয়েছে। তাদের মতামত নিয়েই সব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। প্রিন্টার ও মালিকরা প্রথমদিকে কিছুটা সংকোচে থাকলেও শেষপর্যন্ত তারা রাজি হয়েছেন। কারণ, কাগজ ও বইয়ের মান উন্নয়ন এখন সবার জন্যই জরুরি।”

 

 

সর্বাধিক পঠিত