স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকা জেলার সাভার উপজেলায় ৩টি সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস রয়েছে। কার্যালয়গুলো হলো সাভার সদর, আমিনবাজার ও আশুলিয়া সার্কেল। এ ভূমি অফিসগুলো ঘিরে সাংবাদিকতার সাইবোর্ড ব্যবহার করে দালাল ও তদবির বাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খারিজ-মিসকেস ফাইলের পিছনে দালালচক্র সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে সক্রিয় রয়েছে। এসব দালালরা অনেকেই নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ভূমি অফিসসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রবেশাধিকার ও প্রভাব খাটাচ্ছেন। ফলে সাধারণ সেবাপ্রার্থীরা প্রতিনিয়ত হয়রানি ও অতিরিক্ত আর্থিক চাপের শিকার হচ্ছেন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে একাধিক খারিজ আবেদনে দেখা গেছে, আবেদনকারীর নাম, খতিয়ান ও দাগ নম্বর ভিন্ন হলেও সেখানে একই ব্যক্তির মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়, পেছনে একটি চক্র সক্রিয়ভাবে এসব ফাইল নিয়ন্ত্রণ করছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ফাইলগুলোর পেছনে দালালদের ব্যবহৃত সংকেতিক কোড পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, এসব বিশেষ কোড দিয়ে তারা ফাইল সনাক্ত করে এবং অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বজায় রাখে। দৈনিক ফুলকি–র হাতে একাধিক ফাইল ও এ ধরনের কোড লেখা সংরক্ষিত রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দালালচক্র খারিজ করতে এসিল্যান্ডকে তিন হাজার টাকা, সার্ভেয়ারকে এক হাজার টাকা, কানুনগোকে এক হাজার টাকা এবং তহসিল অফিসে আরও এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। মোট ছয় হাজার টাকার এই ‘অঘোষিত ফি’ না দিলে সাধারণ গ্রাহকের ফাইল বছরের পর বছর চাপা পরে থাকে। অথচ খারিজ (নামজারী) করতে সরকার নির্ধারিত ফি ১,১৭০ টাকা। এরমধ্যে আবেদন ফি ২০ টাকা, নোটিশ জারি ৫০ টাকা, খতিয়ান ফি ১০০ টাকা এবং রেকর্ড সংশোধন ফি ১ হাজার টাকা। বিপরীতে, দালালদের মাধ্যমে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা দিয়ে নামজারী করতে হয়। তবে জমি কোন আইনী জটিলতা থাকলে সে ক্ষেত্রে খরচের কোন সীমারেখা নাই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তভোগী জানান, “আমি নিজে অনেক দিন ভূমি অফিসে ঘুরেও নামজারীর কাজ শেষ করতে পারিনি। শেষে দালাল ধরতেই হলো। টাকা দিলে ফাইল অল্প সময়েই হয়ে যাবে। আমি বাধ্য হয়েই টাকা দিয়েছি।”
সাংবাদিকতার নামে দালালি : অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ‘চ’ আদ্যাক্ষরের এক সাংবাদিক এ তদবির বাণিজ্যের সূচনা করেছিলেন। পরে তদবির বাণিজ্যে প্রচুর আয় দেখে আরও কয়েকজন সাংবাদিক পরিচয়ধারীও এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। তারা সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সাধারণ সেবাপ্রার্থীদের কাছে নিজেদের প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত করায় এবং দালালির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করে।
দলিল লেখক ও অফিস সহকারীদের সম্পৃক্ততা : সাভার সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কিছু দলিল লেখকও দালাল চক্রের অংশ হয়ে পড়েছে। দলিল রেজিস্ট্রির সময়ই তারা গ্রাহকদের সঙ্গে সমঝোতা করে খারিজ পর্যন্ত কাজ করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ কাজে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের কয়েকজন অফিস সহকারীও সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অফিসের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে তারা অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকেন।
পেশাদার সাংবাদিক সমাজের ক্ষোভ : পেশাদার সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, কিছু ভুয়া সাংবাদিকের কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো সাংবাদিক সমাজের মান-সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে। তাদের মতে, “আজকে যারা সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে দালালি করছে, তাদের জন্য প্রকৃত সাংবাদিকদের সামাজিক মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই লজ্জা লাগবে।”
নাগরিক সমাজের দাবি : সাভারের সচেতন নাগরিক সমাজ বলছে, সাংবাদিক পরিচয়ে দুর্নীতি কিংবা ভূমি অফিসকেন্দ্রিক দালালি কার্যক্রম চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ কোনোদিনও হয়রানি থেকে মুক্তি পাবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক নাগরিক জানান, “ভূমি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের এমন যোগসাজশে সাধারণ মানুষ চরমভাবে ভোগান্তির শিকার হয়। এখন আবার কিছু সাংবাদিকও এই চক্রে যুক্ত হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ ভূমি অফিসে সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে হয়রানির শিকার হবে।”
সাভার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসগুলো ঘিরে দালালি, ঘুষ ও সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে এক শক্তিশালী দালাল চক্রে গড়ে উঠেছে। এর ফলে সাধারণ সেবাপ্রার্থীরা ন্যায্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নাগরিক সমাজ ও পেশাদার সাংবাদিক সমাজের দাবি ‘দালাল ও ভুয়া সাংবাদিকদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি, অন্যথায় সাভারের ভূমি অফিসগুলো কখনোই দুর্নীতি মুক্ত হবে না।