স্টাফ রিপোর্টার : সাভার উপশহরসহ এর চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলো চরম দূষণের কবলে। কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে এখানে যেন বিশুদ্ধ বাতাস নেই। নদীর পানিতে যেন বিষ। ফলে এর ওপর নির্ভরশীল এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর সার্বিক স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ আজ বিপন্ন। সাভার উপজেলা মারাত্মক বায়ুদূষণ আক্রান্ত অঞ্চল হিসেবে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান এনডিসি স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে এই ঘোষণা জারি করা হয়। অধিদপ্তরের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, সাভারের বাতাসে দূষণমাত্রা জাতীয় মানের প্রায় তিনগুণ বেশি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, শুষ্ক মৌসুমে প্রায় পাঁচ মাস ধরে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত বায়ু সাভারের দূষিত ধূলিকণা ও ধোঁয়া রাজধানী ঢাকায় ছড়িয়ে দেয়। ফলে শুধু সাভারের জনগণই নয়, ঢাকার কোটি মানুষের শ্বাসযন্ত্রও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, এই ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পর থেকে সাভারের সব ইটভাটা (টানেল ও হাইব্রিড হফম্যান কিলন ছাড়া) ইট পোড়াতে পারবে না। উন্মুক্ত জায়গায় কঠিন বর্জ্য পোড়ানো নিষিদ্ধ থাকবে। পাশাপাশি নতুন কোনো শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্রও দেওয়া হবে না, যদি সেটি বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের গবেষকরা তিন বছর ধরে সাভারে পরিবেশ ও পানি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সাভারের বিভিন্ন এলাকার পানি পরীক্ষা করে মোট ৫০টি নমুনার মধ্যে ৮টি পানির রোটা ভাইরাসের জিবাণু পাওয়া গেছে। গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমানে সাভার অঞ্চলের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। এই ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত বিপজ্জজনক এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শুভ কান্তি দে জানান, সাভার অঞ্চলে নদী ও খাল ভরাট, শিল্পকারখানার দূষণ এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বেড়েছে।
নির্গত শিল্প বর্জ্যের কারণে নদী জলাশয়গুলো মারাত্মকভাবে দূষণের কারণে প্রায় ১ কোটি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এ জনপদের অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত।
এছাড়াও ইটভাটার ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া এলাকার পরিবেশ বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দূষণ প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিদিন দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গৃহস্থালি বর্জ্যের বিপরীতে প্রায় ৭ হাজার শিল্প ইউনিট থেকে নির্গত ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ঘটমিটার শিল্পবর্জ্য মূলতঃ খাল, নদী জলাশয় দূষণের জন্য শতকরা ৬০ ভাগ দায়ী।
রাজধানীর চারপাশে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বংশী, ধলেশ্বরী, শীতালক্ষ্যা, বালু নদের প্রায় ১১০ কিলোমিটার দুর্বিষহ দূষণের শিকার। এসব নদীর তীরে গড়ে উঠেছে অনেক মিল-কারখানা। এসব নদীতে ব্যাপকভাবে শিল্প বর্জ্য ফেলার কারণে পানি দূষিত হতে হতে বিষময় হয়ে পড়েছে। ডাইং ইউনিটগুলোতে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু না হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ পরিবেশ দূষণের শিকার হয়ে জন্ডিস, ডায়রিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, মূত্রনালী ও কিডনিজনিত রোগ, চর্মরোগসহ ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বর্জ্যের বিষক্রিয়ায় আবাদি জমির ফসলের ফলনও অনেক কমে গেছে।
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসহ (ডিইপিজেড) উপজেলার শতাধিক টেক্সটাইল মিল ও ডাইং কারখানা থেকে রাসায়নিক মিশ্রিত গাঢ় কালো ও বেগুনী দূষিত তরল পদার্থ বর্জ্য অবাধে সরাসরি নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে। আর তা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। দূষিত তরল শিল্প বর্জ্যে ফলদ বৃক্ষের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ফলের উৎপাদন হ্রাসসহ পণ্যের আকারও ছোট হয়ে যাচ্ছে। ডিইপিজেডের পাশ দিয়ে বহমান ধলাই বিলের মাছের খ্যাতি ছিল। কিন্তু মিল-কারখানার বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে ধলাই বিলের অনেক মাছ মরে ভেসে উঠছে। এমনকি সাভারের বিভিন্ন খাল ও নদীর মাছ রান্না করলে তাতে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে সাভার উপজেলায় গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক ইটের ভাটা। ইটভাটার নির্গত ধোঁয়ায় এলাকা সবসময় ধোঁয়াচ্ছন্ন থাকে। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ থাকলেও আইনকে তোয়াক্কা না করে ইটভাটার মালিকরা কাঠ পোড়ানোর পাশাপাশি গাড়ির টায়ার, পোড়া মবিল, পলিথিন ও রাবার জাতীয় দ্রব্যাদি পোড়ানোর কারণে পরিবেশ চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে। আবাসিক এলাকায় ইটভাটা নির্মাণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকলেও খোদ সাভার পৌরসভার ভিতর একাধিক ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় ছাত্রছাত্রীদের মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। এলাকাবাসীর শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দিয়েছে। বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ রফিক বলেন, যানবাহন থেকে শুরু করে ইটভাটার কালো ধোঁয়া শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য অবশ্যই দূষণমুক্ত পরিবেশ আবশ্যক।
সাভারের পরিবেশ আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক দীপক কুমার রায় বলেন, কল-কারখানার বর্জ্য দূষণ অব্যাহত থাকলে রাজধানীসহ আশপাশের কয়েকটি অঞ্চল আগামী কয়েক বছরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।