বৃহস্পতিবার, 21 আগস্ট 2025
MENU
daily-fulki

মানিকগঞ্জে পাটুরিয়ায় নদী ভাঙন: নিঃস্ব ঘাট পাড়ের অন্তত ৩০টি পরিবার


মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি : পাটুরিয়া ঘাট টারমিনাল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। নদীভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বাপ-দাদার ভিটায় বংশপরম্পরায় বসবাসকারী মোয়াজ্জেম হোসেন, গুপি সেন, পঙ্কজ পাল, রাজিয়া বেগমসহ ত্রিশটি পরিবার। গত কয়েক দিনের অব্যাহত নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে সবাই এখন নিঃস্ব।


পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় আশ্রয় নিবে এমন দুশ্চিন্তায় কাটছে তাদের দিন-রাত। এসব অসহায় পরিবারের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। অনেক নেতাই নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে গেছেন কিন্তু কেউ তাদের কোনোরকম সাহায্য করেনি। সবাই ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্বাস দিচ্ছে এবং ফটোসেশন করে চলে যাচ্ছে। সরেজমিন নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা দেখতে গিয়ে জানা গেছে এসব কথা। মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার আরুয়া ইউনিয়নের পাটুরিয়া ৫নং ফেরিঘাটসংলগ্ন ধুতরাবাড়ি, তেঘড়ি ও বরুরিয়া গ্রামের মানুষের মাথা গোঁজার সর্বশেষ ঠাঁইটুকু কেড়ে নিয়েছে রাক্ষুসী পদ্মা। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে এখন পর্যন্ত কেউ দাঁড়ায়নি! এমন অভিযোগ ক্ষতিগস্ত প্রতিটি পরিবারের। এছাড়াও হুমকির মধ্যে রয়েছে- পাটুরিয়া লঞ্চ ও ফেরিঘাট। পদ্মা সেতু হওয়ার পরও পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটের যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা।

 

পাটুরিয়া ৫নং ফেরিঘাটের পাশেই পদ্মা পাড়ের ধুতরাবাড়ি গ্রামের পাশাপাশি বসবাসকারী গুপি সেন ও পঙ্কজ পাল গত শনিবার রাতে খাবার শেষে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলেন তারা। রাত গভীরে পদ্মার শোঁ-শোঁ শব্দ আর পাড় ভাঙার গর্জনে ঘুম ভাঙে তাদের। এক মুহূর্তেই চোখের সামনেই নদীতে ভেঙে দেবে যায় বিশাল আকারের কয়েকটি টিনের ঘর, মুরগির ফার্মসহ বেশ কিছু গাছপালা। নিরবে নিস্তব্ধে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমাদের। বাকরুদ্ধ সব পরিবার এখন নিঃস্ব। পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় ঠাঁই নিবেন এমন দুশ্চিন্তা এদের চোখে-মুখে। ভাঙনের শিকার তেঘড়ি গ্রামের বসতি পঞ্চাশোর্ধ গোলাপী বেগম বলেন, আমার স্বামীর বাপ-দাদার জন্ম ভিটা এইটা। এখানে মুরুব্বিদের কবর ছিল। এ বাড়িতে আমার বিয়ে হয়েছে ৩৫ বছর হলো। এটাই আমার শেষ ঠিকানা। আমার স্বামী ও শ্বাশুড়ি দু’জনেই অসুস্থ। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখন কোথায় যাব এই বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন গোলাপী বেগম।

 

পার্শ্ববর্তী বরুরিয়া গ্রামে বসবাসকারী রাজিয়া বেগম বলেছেন, বিগত কয়েক যুগ ধরে পাটুরিয়া ঘাটের কাছে পদ্মার পাড়ে বসবাস করছি আমরা। এবার নদীতে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন দেখা দেয় লঞ্চঘাট এলাকায়। একদিনের মধ্যেই ভেঙে যায় লঞ্চঘাটের জেটি। এরপর ভাঙন দেখা দেয় ফেরিঘাট এলাকায়। কয়েক দিনের ব্যবধানে ৫নং ফেরিঘাটটিও পদ্মা নদীতে ভেঙে পড়ে। হুমকির মুখে পড়ে আমাদের পুরো গ্রাম। গত রোবরার রাতে আমাদের বাড়িঘর নদীতে ধসে যায়। স্থানীয়দের সহায়তায় ঘরের টিন ও দরজা-জানালা খুলে সরানোর চেষ্টা করি। ঘরে থাকা ফ্রিজ-টিভিসহ মূল্যবান অনেক জিনিসই নদীতে ভেসে গেছে।

 

স্থানীয় আরুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মুন্সী আপেল মাহমুদ বললেন, পাটুরিয়া ঘাট এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় গত দুই-সপ্তাহ যাবৎ ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দেয়। ফেরি ও লঞ্চঘাটসহ ৩০টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সরকারি-বেসরকারিভাবে কেউ এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এই সব পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি। আমরা বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঘাট কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএকে অবহিত করেছি। তারাও প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এতে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে গত রোববার ঘাট এলাকায় বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে।

 

নাম গোপন রাখার শর্তে একজন জনপ্রতিনিধি বলেছেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পাড় থেকে অবৈধভাবে চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের বালু-মাটি উত্তোলন ও বিআইডব্লিউটি-এর অপরিকল্পিত ড্রেজিং কার্যক্রমের ফলে ঘাট এলাকাসহ নদী পাড়ে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এতে কর্তৃপক্ষ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। এখানে ঘাট কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ, ফেরি সেক্টর বিআইডব্লিউটিসি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো সমন্বয় করছে না। ঘাট ও নদীর পাড় রক্ষায় দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের দাবি জানালেন তিনি।

 

এদিকে বিআইডব্লিউটিসি আরিচা অঞ্চলের তথা ফেরি সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত ডিজিএম আব্দুস সালাম বলেছেন, নদীর তীব্র স্রোত ও ভাঙনের কারণে পাটুরিয়া ৫নং ঘাটটি গত কয়েক দিন আগে ভেঙে পড়েছে। যার কারণে এই ঘাট দিয়ে ফেরিতে যানবাহন লোড-আনলোড বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশের ৪নং ফেরিঘাটটিও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মাত্র একটি পকেট দিয়ে লোড-আনলোড করানো হচ্ছে। তাছাড়া ৩নং ঘাট দিয়ে সর্তকতার সঙ্গে ফেরিতে যানবাহন লোড-আনলোড করা হচ্ছে। ঘাট স্বল্পতায় আমাদের বহরের ১৫টি ফেরির মধ্যে আপাতত ছোট-বড় ১০টি ফেরি অপারেশনে আছে। নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে প্রতিটি ফেরির ট্রিপ সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। তবে ঘাট এলাকায় পাড়ের অপেক্ষায় থাকা যানবাহনের লাইন দীর্ঘ হলেও যাত্রীবাহী যানবাহন প্রাধান্য দিয়ে তা সিরিয়াল অনুযায়ী পারাপার করা হচ্ছে।

ঘাট কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী নেপাল চন্দ্র দেব নাথ বলেন, ভাঙন রোধ ও ফেরি সার্ভিস সচল রাখতে যথাযথ চেষ্টা করা হচ্ছে। ভাঙন এলাকায় বালুভর্তি ২৭শ’র অধিক জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। গত সোমবার আমাদের সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঘাট এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। এমন জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা ফেরি কর্তৃপক্ষসহ পত্র মারফত পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও অবগত করেছি।

এসব বিষয়ে মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেছেন, পাটুরিয়া ফেরি এবং লঞ্চঘাটগুলো বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক পরিচালনা করা হয়। রাজস্ব আদায়সহ নদীশাসন থেকে শুরু করে সবকিছু তারাই করে থাকে। কিন্তু আমাদের যদি কোনো ইন্সট্রাকশন দেয়া হয় আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করবো। কারিগরি সহযোগিতা থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত আছি।

এ বিষয়ে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেন, ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। এদের সাহায্যার্থে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারিভাবে সহায়তা করা হবে।

 

 

সর্বাধিক পঠিত