বৃহস্পতিবার, 9 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

এলডিসি থেকে উত্তরণ পেছানোর চিন্তা

ফুলকি ডেস্ক : স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদনের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। তবে এখনই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে আরও কিছুদিন সার্বিক প্রস্তুতি পর্যালোচনা করা হবে। এর পর যদি সরকার মনে করে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় পেছানো দরকার, তাহলে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে সরকারের এমন অবস্থানের কথা জানা গেছে।

সম্প্রতি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার জোর দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা সরকারকে উত্তরণ পেছানোর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের দাবি, এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। গণঅভুত্থানের মাধ্যমে দেশে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপ হয়েছে। সামনে নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে কোনো কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে তখন অর্থনীতিতে নতুন সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় তারা এলডিসি থেকে উত্তরণে আরও সময় নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হবে কিনা, সরকার চাইলেই সময় পেছাতে পারবে কিনা– এমন প্রশ্ন সামনে এসেছে।

 

 

গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ– এমন সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। সেই হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে সময় ১৫ মাস। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এলডিসি উত্তরণ পেছানো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে গত মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ২০২৬ সালেই এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেয়।

এলডিসি থেকে উত্তরণ বিষয়ে সরকারের বর্তমান অবস্থান জানতে চাইলে গতকাল রোববার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা চিন্তাভাবনা করছি। তবে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জগুলো নিতে হবে। অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিলে প্রস্তুতি নিতে ভালো হয়। না হলে ব্যবসায়ীরা সব সময় বলে, প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি। উত্তরণ থেকে পেছানোর জন্য জাতিসংঘে কোনো আবেদন করা হবে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পেছাতে এখনই আমরা আবেদন করব না। এটি নির্ভর করবে প্রস্তুতির ওপর। কারণ ২০২৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময় রয়েছে।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জাতিসংঘের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগেই মসৃণ উত্তরণ কৌশল গ্রহণ করেছিল সরকার। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে গত এক থেকে দেড় বছরে এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারের প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। তা ছাড়া আগের সরকারের সময় উত্তরণের সূচকগুলোতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় তারা ইঙ্গিত পেয়েছেন যে, পেছানোর আবেদন করলে কিছুটা বাড়তি সময় পাওয়া যেতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল  বলেন, সময় পেছানোর আবেদনের বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, আগামী মার্চে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসিতে (সিডিপি) এলডিসি উত্তরণ নিয়ে তৃতীয় পর্যালোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগেই পেছানোর আবেদন করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

এদিকে নির্ধারিত সময়েই এলডিসি উত্তরণের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে গতকাল  জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, মসৃণ উত্তরণ কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই বেসরকারি খাতের সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ব্যবসা পরিচালনা সহজ করতে বেশ কিছু লজিস্টিক সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে, যা উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।

তিনি আরও বলেন, উত্তরণ প্রস্তুতি নিয়ে শিগগিরই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তারের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করা হবে। এসব আলোচনা কোনো ঘাটতি পরিলক্ষিত হলে তা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া এই নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি সংলাপ আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। তারপর যদি সরকার মনে করে সময় পেছানো প্রয়োজন, তাহলে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতেই পারে। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, বর্তমানে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের যথাযর্থ অবস্থায় রয়েছে।

গত ১০ আগস্ট রাজধানীর গুলশান ক্লাবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘আগের সরকার যে এলডিসি উত্তরণের সময়বদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়েছে, তা এখন আমাদের জন্য চাপা বিস্ফোরণ–একটি টাইম বোমা। এর ফলে বাংলাদেশ রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, ভর্তুকির সুবিধা এবং সহজ শর্তে বৈদেশিক সহায়তা হারাবে।’ তাঁর মতে, এ ঝুঁকির জন্য অতীতের সরকার যথাযথ প্রস্তুতি ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়াই শুধু রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ‘এলডিসি উত্তরণ’কে ব্যবহার করেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা– এই তিন সূচকের ভিত্তিতে এলডিসি উত্তরণ করা হয়। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যদি কোনো দেশ দ্বিতীয় পর্যালোচনার পর এসব সূচকে পিছিয়ে যায়, তাহলে উত্তরণ পিছিয়ে দেয় জাতিসংঘ। তবে বাংলাদেশ তো এখনও তিনটি সূচকেই ভালো অবস্থায় রয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘে দেওয়া ‘ভলেন্টিয়ার ন্যাশনাল রিভিউ’তে গত এক বছরের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বিকল্প উপায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সূচকগুলো ভুল– তা প্রমাণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক অডিটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখাতে হবে যে, তিনটি সূচকের অন্তত দুটি উত্তরণের যোগ্যতার নিচে। আরেকটি উপায় হচ্ছে, যৌক্তিকতার ভিত্তিতে এমন প্রাক্কলন দেখাতে হবে যে, উত্তরণের পর দেশের অর্থনীতি তিনটি সূচক নির্ধারিত মানদণ্ডের নিচে নেমে যাবে। এটি দেখানোও সহজ হবে না।

গত বৃহস্পতিবার পোশাক, ওষুধসহ রপ্তানির বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণ তিন থেকে ছয় বছর পেছানোর দাবি করেন। গত শনিবার বাংলাদেশ চেম্বারের এক সেমিনারে বক্তারা বলেন, উত্তরণের পর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধ শিল্প। ওষুধ শিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এতে ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে সফটওয়্যার ও বইসহ বিভিন্ন পণ্যের কপিরাইট ইস্যুতে বাড়তি টাকা খরচ হবে।

 

সর্বাধিক পঠিত