শুক্রবার, 10 অক্টোবর 2025
MENU
daily-fulki

‘আমার জুলাই এখনও চলমান’

ফুলকি ডেস্ক : আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। গত বছর জুলাইয়ের ১ তারিখ যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থীই আন্দোলনের বিষয়ে সচেতন ছিল। আমরা মেয়েরা সিদ্ধান্ত নিই, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভাইদের সঙ্গে সংহতি জানাব, তাদের সঙ্গে মাঠে নামব। অনেক বান্ধবীদের বললাম। তারা আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছিল না। ব্যাচ গ্রুপে কথা বলে সংহতি জানিয়ে ক্লাস বর্জন করলাম ১ জুলাই থেকে। 

আমি আন্দোলনে সরাসরি ৩ জুলাই থেকে অংশগ্রহণ করি। ৪ তারিখ অনেক লম্বা মিছিল হয়, সেখানে আমি পলাশী পর্যন্ত গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বসে রেস্ট নিই এবং তাদের সঙ্গে একটা সুন্দর আলাপ হয় কোটাবিষয়ক। তারা আমাকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করছিল একাত্মতা ঘোষণা করে। ওই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা রিকশা ভাড়া করে আমার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে শুরু হলো বড় আন্দোলন। সরকারের পক্ষ থেকে যত বাধা এসেছে, আন্দোলন তত বড় হয়েছে। আন্দোলনে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি যুক্ত হলো। এর মধ্যে আমি মেয়েদের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করে যাই। সবাইকে ফেসবুক গ্রুপ, মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত করার মাধ্যমে আমরা আন্দোলনের প্রচারণা চালিয়েছি। ১২ জুলাই আমার বন্ধু রিফাত রশিদ আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে হলের জন্য আলাদা ব্যানার করে দিয়েছিল। সেদিন রাত ২টা পর্যন্ত আমরা সুফিয়া কানাল হলে প্ল্যাকার্ড তৈরি করি। ওইদিন আমরা হল থেকে বড় মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সবার সঙ্গে যোগ দিই। তখন বুঝতে পারি অনাবাসিক ছাত্রীরা মিছিলে যোগ দিতে পারছে না। পরে আমি বিভাগের আপুদের সঙ্গে কথা বলে সবাইকে ডিপার্টমেন্টের পক্ষে থেকে ব্যানারসহ মিছিলে নেওয়ার ব্যবস্থা করি।

 

 

১৪ তারিখ পর্যন্ত মোটামুটি আন্দোলন বলতে গেলে স্বাভাবিক গতিতেই ছিল। এ সময় নাহিদ ইসলাম আর সার্জিস আলমের সঙ্গে আমাদের ১০ জন মেয়ের অনলাইন মিটিং হয়। এর মূল উদ্দেশ্য, একটা সমন্বয়ক টিম গঠন করা এবং মেয়েদের উপস্থিতি বাড়ানোর লক্ষ্যে। মেয়েদের অবস্থান শাহবাগ বা মূল আন্দোলনের স্থানে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মেয়েদের নিরাপত্তার স্বার্থে। ১৪ জুলাই তৎকালীন সরকারপ্রধান যখন আমাদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে উল্লেখ করেন, তখন রাতে আমরা হলের মেয়েরা একসঙ্গে বের হয়ে ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার/কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার!’ স্লোগান দিয়েছি। এ সময় আমাদের কারও হাতে ছিল খুন্তি, কারও বা ছিল গ্লাস বা চামচ হাতে। আমরা নারীদের উপস্থিতি এবং নারীদের ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের জানিয়ে দিলাম, আমাদের হাতে যা আছে তা দিয়েই আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। আমি তখন একটা বড় ফেসবুক গ্রুপ ‘কোটা পুনর্বহাল চলবে না’-এর মডারেটর হিসেবে কাজ করি। এই গ্রুপের মাধ্যমে আমরা সারাদেশের প্রতিটা সেকেন্ডের আপডেট পেতে থাকি। ১৪ তারিখ রাতে আন্দোলনের পর সবাই সবার হলে ফিরে যায়। রাত ৩টায় ছাত্রলীগ একটা ঝটিকা মিছিল মহড়া দিতে থাকে ক্যাম্পাসে এবং হুঁশিয়ারি দেয়– পরের দিন যারা বের হবে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবে। এ সময় তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরও তাদের পক্ষে বলেন, ‘তাদের ঠান্ডা করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ এ ধরনের আলাপের পর আমরা জানতাম না যে আক্রমণ আসবেই। 

১৫ তারিখ আমরা যখন মিছিল নিয়ে যাই আমাদের ওপর হলপাড়ায় প্রথম আঘাত হয় ছাত্রদের ওপর। তখন আমরা যারা রাজুতে বা বিভিন্ন জায়গায় ছিলাম হলপাড়ার দিকে ছুটলাম। সাংবাদিক থেকে শুরু করে সবার ওপর তারা হামলা করল ভাড়া করা সন্ত্রাসীদের দিয়ে। তখন আমাদের অনেক নারী শিক্ষার্থী ছেলেদের হলে আটকে গেল এবং আহত হলো। বিকেলে গিয়েও যথেষ্ট চিকিৎসা সেবা পায়নি। আমি সলিমুল্লাহ হলে কিছুক্ষণ থেকে বাসায় চলে আসি। আমি কান্না করছিলাম আর সবাইকে কল দিয়ে সবাই ঠিক আছে কিনা জানতে চাচ্ছিলাম। এদিন আমি নিজে আহত হইনি; কিন্তু আমি খুবই ভয়ের মধ্যে ছিলাম যে কোনো সময় আঘাত হতে পারে– এ রকম ভয় পাচ্ছিলাম। 

১৬ তারিখ বেলা ৩টার দিকে শহীদ মিনারে আমাদের অবস্থান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। হামলার প্রতিবাদে তখন আমরা পাঁচ হলের মেয়েরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তো অনেক আহত, প্লাস অনেকেই অনেকের বাড়িতে চলে গেছে– এ অবস্থায় আমরা মোমবাতি প্রজ্বালন, দ্রোহ গান– এ ধরনের প্রোগ্রাম করব। হলে হলে মোমবাতি দিয়ে ও প্রতিবাদী গান হয়। ওই দিন আমরা বুঝতে পারছিলাম, ছাত্রলীগও একটু ব্যাকফুটে আছে। তারা মোটামুটি হল ত্যাগ করার মতো অবস্থা।

প্রথম ছাত্রলীগ তাড়ায় মেয়েরা। সেদিন রাতেই সিদ্ধান্ত হলো, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ। প্রথমে রোকেয়া হলে শুরু হলো প্রতিবাদ। লীগের নেত্রীরা প্রভোস্টের সহযোগিতায় হলে ঢোকার চেষ্টা করলে, কয়েকজন তাদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। সেই ভিডিও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তা আমাদের সবাইকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। রোকেয়া হলের দেখাদেখিতে প্রতিটা হলে এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমি আমার সিনিয়র আপুদের জানালাম,  রোকেয়া হলে যেহেতু নিষিদ্ধ হয়েছে, আমরা আমাদের হলেও নিষিদ্ধ করব। সেদিন সারারাত মেয়েরা এটা নিয়ে পড়ে থাকে। পরের দিন সকালে সাইন এবং স্মারক নম্বর, আরও অনেক কিছু লাগত। এগুলোর জন্য সারারাত-সকাল দৌড়াদৌড়ি করে দুপুর পর্যন্ত ম্যাম আমাদের পক্ষে কথা বললেও পরে জানালেন, ‘আজ ৬টার মধ্যে সবাই হল ত্যাগ করো, আমরা তোমাদের দায়িত্ব নিতে পারব না।’ 

তখন ছেলেমেয়েরা বাধ্য হয়েই হল ছাড়ে; কিন্তু আমার অনেক বান্ধবী আছে যাদের ঢাকায় থাকার মতো কোনো আত্মীয় নেই। আমি তখন হল গ্রুপে জানালাম, ১০-১২ জন বাদে যতজন আছ, সবাই আমার বাসায় আসো, আজকে রাত বা আগামীকাল পর্যন্ত আমরা পারলে বাসায় বসে থাকব– তাও একসঙ্গে থাকি। ওই দিন আমার বান্ধবী আমার সঙ্গে আমার বাসায় ছিল। পরদিন সে অনেক কষ্ট করে বাড়ি চলে যায়। পরিচিত অনেক আপুরা এমনকি থাকার জায়গা না পেয়ে টিউশন করে যে বাসায় সেখানে উঠেছে। তখন হলের মেয়েদের কী কষ্ট, আতঙ্ক কাজ করছিল, সে পরিস্থিতি বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

১৬ তারিখ আমরা শুনতে পাই, আমাদের সহযোদ্ধা রংপুরের আবু সাঈদ নিহত, চট্টগ্রামের ওয়াসিম নিহত– এমন অনেকের খবর আমরা পেতে থাকি। এভাবেই শেষ হলো আমাদের ক্যাম্পাস আন্দোলনের জার্নি। এরপর ক্যাম্পাস বন্ধ, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। একসময় শুনতে পাই বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ব্লক রেইড দিয়ে গণগ্রেপ্তার করছে। আইডি কার্ড নিয়ে বের হতে ভয় পাচ্ছিলাম– এ রকম একটা অবস্থা। যখন আবার ইন্টারনেট এলো, আমরা জানতে পারলাম, এর মধ্যে আমাদের অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছে এবং অনেকে আহত, আবার অনেকে কারাবন্দি। এসবের পর এটা আর কোটা আন্দোলন ছিল না। যেহেতু সরকার এখানে প্রাণ নিয়েছে, রক্তের  মূল্য  কোটা দিয়ে পূরণ করা যায় না। এমন সময় কয়েকজন সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে বন্দুকের মুখে রাজি করায় যে তারা আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাইরে থাকা সমন্বয়করা বুঝতে পারে যে তাদের বন্দুকের মুখে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা যারা বাইরে আছি তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আগস্ট তাদের শোকের মাস, শোক পালন করতে তারা যেহেতু কালো ব্যাজ ধারণ করবে, এর আগেই ৩০ জুলাই থেকেই আমরা লাল ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি চালিয়ে যাই। আমরা বুঝে যাচ্ছিলাম, কে সরকারের পক্ষে কালো ধারণ করে আর কে লাল। দেশ লাল আর কালো তখন দুই পক্ষ হয়ে গিয়েছিল।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য অরাজকতা চালাচ্ছেন বুঝতে পেরে রাস্তায় নেমে আসেন আপামর জনসাধারণ। হত্যা, আটক চলতে থাকে। তখন বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী আমাদের পক্ষ নিতে শুরু করে। ৪ আগস্ট ঘোষণা হয়েছিল, ৬ আগস্ট হবে ‘মার্চ ফর ঢাকা’। পরে তড়িঘড়ি এ কর্মসূচির সময় একদিন এগিয়ে আনা হয়। 

ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট আমরা সবাই শাহবাগ গেলাম, তখনই শুনলাম যে ছাত্র-জনতা গণভবনে ঢুকে গিয়েছে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়েছেন। তিনি পালানোতে সমাধান হয়নি; বরং এমন অগণতান্ত্রিকতা যেন না গড়ে ওঠে এমন ব্যবস্থা গঠন জরুরি। আমি চাই প্রত্যেক আহত ব্যক্তির সুচিকিৎসা, নিহতদের হত্যার যথোপযুক্ত বিচার, দলীয়ভাবে এ হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকায় আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ করা হোক। তাই আমার জুলাই এখনও চলমান।

সর্বাধিক পঠিত