স্টাফ রিপোর্টার : জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ঢাকা জেলার আশুলিয়ায় ৬ আন্দোলনকারী তরুণের লাশ পোড়ানো হয় দিয়াশলাইয়ের আগুনে। আশুলিয়া থানার সাবেক পুলিশ পরির্দশক (ওসি) এএফএম সায়েদের ইশারায় সাবেক এসআই মালেক ম্যাচের একটি কাঠিতে আগুন ধরিয়ে ভ্যানে নিক্ষেপ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। উপস্থিত ধূমপানরত এএসআই বিশ্বজিৎ সাহা তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটি দেহগুলোর ওপর নিক্ষেপ করেন। তৎকালীন কনস্টেবল মুকুল চোকদার এতে সহায়তা করেন। এর আগে একজন কনস্টেবল দাহ্য পদার্থযুক্ত কাপড় লাশগুলোর ওপর রাখেন। এতে পুরো ভ্যান গাড়িতে আগুন ধরে যায়। অঙ্গার হন ৬ আন্দোলনকারী।
এমন নৃশংস ঘটনার বর্ণনা উঠে এসেছে মামলার অভিযোগপত্রে। বৃহস্পতিবার অভিযোগ গঠনের ওপর প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি হয়। গত ২ জুলাই ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেয় প্রসিকিউশন এবং তা আমলে নেওয়া হয়। আসামিপক্ষের শুনানি হবে ১৩ আগস্ট। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই বিচারক হলেন মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
গত বছরের ৫ আগস্ট সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানার সামনে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর বাইরে আরও একজন গুলিতে গুরুতর আহত হন। একজনকে জীবিত এবং পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় প্রথমে একটি ভ্যানে তোলা হয়। পরে এই ছয়জনকে (একজন গুরুতর আহত) আগুনে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ। তারা হলেন-সাজ্জাদ হোসেন (সজল), আস সাবুর, তানজীল মাহমুদ সুজয়, বায়েজিদ বুসতামি, আবুল হোসেন এবং একজন অজ্ঞাত। ১১ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। অভিযোগটি আমলে নিয়ে ৮ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে এ মামলায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিন সকালে আট আসামিকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন-ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) আব্দুল্লাহিল কাফী, সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, আবজাল হোসেন ও কনস্টেবল মুকুল। এ মামলার সাবেক সংসদ-সদস্য সাইফুল ইসলামসহ ৮ আসামি পলাতক আছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটারদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এই খবরে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল নিয়ে বাইপাল এলাকা থেকে আশুলিয়া থানার দিকে আসে। বিকাল ৪টার দিকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে পুলিশ ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মীরা ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে গুলি বর্ষণ করে। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ৫ জন। একজন গুরুতর আহত হন। গুলিবর্ষণের ফলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় কনস্টেবল মুকুল চোকদার অন্য একজন পুলিশ সদস্য ৫ জনের লাশ তিন চাকার একটি প্যাডেল ভ্যানে স্তূপ করেন।
পরে আশুলিয়া থানার ভেতর থেকে পুলিশের একটি ছাউনিযুক্ত পিকআপ ভ্যান বের করে এনে থানার সামনের রোডে দাঁড় করান। কনস্টেবল মুকুল চোকদার অন্য একজনের সহায়তায় প্যাডেল ভ্যানে থাকা লাশগুলো পুলিশের পিকআপ ভ্যানে তোলেন। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত এক ব্যক্তিও ছিলেন। এ সময় একটি ত্রিপল দিয়ে দেহগুলো ঢেকে দেওয়া হয়। একজন কনস্টেবল দাহ্য পদার্থযুক্ত কাপড়ের টুকরা পিকআপ ভ্যানের ওপর রাখেন। পুলিশ পরির্দশক এএফএম সায়েদ ইশারা দিলে এসআই মালেক ম্যাচের একটি কাঠিতে আগুন ধরিয়ে ভ্যানে নিক্ষেপ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। উপস্থিত ধূমপানরত এএসআই বিশ্বজিৎ সাহা তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটি দেহগুলোর ওপর নিক্ষেপ করেন। একজন পুলিশ সদস্য জ্বলন্ত ভ্যানে জ্বালানি হিসাবে কাঠের বেঞ্চ নিক্ষেপ করেন। এভাবেই আসামিরা ৬ জনকে পুড়িয়ে অঙ্গারে পরিণত করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, এ সময় পুলিশ পরির্দশক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান, পরির্দশক (অপারেশন) নির্মল কুমার দাস ও ঢাকা জেলা ডিবির (উত্তর) পুলিশ পরিদর্শক আরাফাত হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও এতে বাধা দেননি। তদন্তকালে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ভ্যানের আশপাশে আরও লাশ পড়ে ছিল।
বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ, ফারুক আহাম্মদ, সাইমুম রেজা তালুকদার ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান। প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ বলেন, আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর মামলায় ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আবেদন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে শুনানি করে প্রসিকিউশন। অভিযোগ গঠনের পর সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। শুনানি শেষে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীম সাংবাদিকদের বলেন, আশুলিয়ায় দুটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। প্রথমটি হলো, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আশুলিয়ায় ৪ আগস্ট একজনকে ও ৫ আগস্ট ছয়জনকে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয়ত, পাঁচ লাশ ও একজনকে জীবিত অবস্থায় পুড়িয়ে তাদের শরীর বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে। দুটিই মানবতাবিরোধী অপরাধ।