স্টাফ রিপোর্টার : দেশের পুঁজিবাজারে গত ১৫ বছরে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ উৎপাদনে রয়েছে। পুঁজিবাজারে নানা নেতিবাচক কথা প্রচলিত থাকলেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রায় ৮৫ শতাংশ কোম্পানিই উৎপাদনে আছে। তবে তালিকাভুক্ত কোম্পানির একটি অংশ আর্থিকভাবে দুর্বল, কিছু লভ্যাংশ দেয় না, কিছু কোম্পানি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদিও বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। তবে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ণ এবং সুশাসন নিশ্চিত করা হলে এসব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সেইসাথে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দূর করে পুঁজিবাজারে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে বলে মনে করেন তাঁরা।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা অর্থনীতির তুলনায় কম
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য বিশ্লষণ করে দেখা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ডিএসইতে নতুন তালিকাভুক্ত হয়েছে ১৩৮টি কোম্পানি। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অর্থনীতির আকার ও প্রবৃদ্ধির তুলনায় এই সংখ্যা হতাশাজনক।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতির আকার আড়াই লাখ কোটি টাকা থেকে বেড়ে অর্ধ ট্রিলিয়নে পৌঁছালেও তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ও আকার সেই অনুপাতে বাড়েনি।
পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি না আসার ফলে বাজারের গভীরতা বাড়ছে না, বরং সামগ্রিক জিডিপিতে বাজার মূলধনের অনুপাতও কমেছে। এক সময় এই অনুপাত ছিল ৩০ শতাংশের কাছাকাছি, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ১৩ শতাংশে।
তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী মনে করেন তালিকাভুক্ত কোম্পানির এই সংখ্যা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তবে আরও কিছু কোম্পানি আসতে পারতো বলে মনে করেন তিনি।
৮৫ শতাংশ চালু, তবে সবার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৮৪.৭৮ শতাংশ এখনো উৎপাদনে সক্রিয় আছে। আংশিকভাবে চালু কোম্পানির সংখ্যা ৭.৯৭ শতাংশ, আর ৬.৫২ শতাংশ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
এছাড়া এই সময়ের মধ্যে ২১.৭৪ শতাংশ কোম্পানি কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। অর্থাৎ তালিকাভুক্ত হওয়া প্রতি পাঁচটি কোম্পানির একটি বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একটি গুরুতর ইঙ্গিত যে শুধু তালিকাভুক্ত হওয়াই যথেষ্ট নয়, কোম্পানির আর্থিক স্বচ্ছতা, শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং টেকসই লাভজনক অবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি।
আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে বাংলাদেশ
বাজার মূলধন, জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ, এসব দিক থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। যেখানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারের দিক থেকে এশিয়ার মধ্যে নবম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হলো বাংলাদেশ। সেখানে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সন্তোষজন অবস্থায় নেই।
এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বিবেচনায় দেখা যায়, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রায় সব দেশই বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩৬০। যেখানে ভারতে ৫ হাজার ৫৬৪, পাকিস্তানে ৫২৩, থাইল্যান্ডে ৮৮৫, ভিয়েতনামে ৪৩৫ এবং ইন্দোনেশিয়ার পুঁজিবাজারে ৯৪৩টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বিবেচনায় ফিলিপাইন ও শ্রীলংকা বাদে বাকি সব দেশই বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। এ দুই দেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা যথাক্রমে ২৮৫ ও ২৯০।
জিডিপিতে পুঁজিবাজার মূলধনের তুলনা করে দেখা যায়, সিংগাপুরে ১৫১ দশমিক ৬৩, হংকংয়ে ১ হাজার ১৩৮ দশমিক ৩৫, ভারতে ৯৮ দশমিক ৩৭ ও পাকিস্তানে ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে জিডিপিতে বাজার মূলধনের অনুপাত এক সময়ে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে।
আসছে সংস্কার, বাড়বে আস্থা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অনেক কোম্পানির লভ্যাংশ না দেওয়া বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে এবং পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট তৈরি করে। তবে সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কয়েকটি বিষয়ে চূড়ান্ত সুপারিশ দিয়েছে পুঁজিবাজার উন্নয়নে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি। সেগুলোকে আইনে পরিণত করতে কাজ করছে বিএসইসি। এছাড়াও টাস্কফোর্সের অন্যান্য সুপারিশগুলোও খুব দ্রুতই বিএসইসির কাছে উপস্থাপনের কথা বলা হয়েছে টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে। বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলো আইনে পরিণত হলেই বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
সেইসাথে নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। সম্প্রতি সরকারী মালিকানাধীন বিদুৎ ও জ্বালানী খাতের কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে বিএসইসি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে। এছড়াও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এর পক্ষ থেকে নতুন কোম্পানি খুব কম সময়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটি চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম।
তালিকাভুক্তির আগে যাচাই, সুশাসন ও বিনিয়োগে জোর
বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে টেকসই ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে কোম্পানির আর্থিক স্বচ্ছতা, কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা এবং নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদানের উপর জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি যাচাইয়ের প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করা দরকার।
পুঁজিবাজারের এমন পরিস্থিতিতে সুশাসনে জোর দিয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি বদলাতে হলে প্রয়োজন সুশাসন। এটার কোন বিকল্প নাই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে জোর দিয়ে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, তালিকাভুক্তি তখনই হবে যখন টাকার প্রয়োজন হবে। যখন কেউ বিনিয়োগ করতে চায়। বাংলাদেশে তো গত এক দেড় বছরে বিনিয়োগই নাই। ব্যাংকে টাকা পড়ে আছে, তাহলে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে কেন আসবে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক যুগে পুঁজিবাজারে কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই, তবে গুণগত মান, সুশাসন ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। পুঁজিবাজারে গুণগত কোম্পানি আনতে হলে তালিকাভুক্তির আগে প্রকৃত আর্থিক অবস্থা যাচাই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন সুশাসন, কার্যকর তদারকি এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা।