স্টাফ রিপোর্টার : সৌদি সরকারের রোডম্যাপ অনুযায়ী, আগামী বছরের (২০২৬ সাল) হজের কার্যক্রম বেশ আগেভাগেই সম্পন্ন করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হজের এত আগে নিবন্ধন সম্পন্ন করে প্যাকেজের টাকা সৌদি প্রান্তে পাঠানো বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া রয়েছে অন্য কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের চাপ।
এরই মধ্যে নুসুক মাসার প্ল্যাটফর্মে সৌদি সরকার আগামী হজের কোটা জানিয়ে দিয়েছে। গত কয়েক বছরের মতো আগামী বছরও বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনা মিলিয়ে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ পালন করতে পারবেন। যদিও গত দুই হজে কোটা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী বছরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে সৌদি আরবে পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। গত বছর ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হজযাত্রী নিবন্ধন চললেও রোডম্যাপ অনুযায়ী, এবার ১২ অক্টোবরের মধ্যে প্যাকেজের পুরো টাকা নিয়ে হজের নিবন্ধন শেষ করতে হবে। সেবা প্যাকেজের (তাঁবু ভাড়া ও মাশায়ের প্যাকেজ) প্রয়োজনীয় অর্থ সৌদিতে পাঠাতে হবে ২১ ডিসেম্বরের মধ্যে।
আগামী বছরের ৪ জানুয়ারি নুসুক মাসার প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সার্ভিস কোম্পানির সঙ্গে সেবা গ্রহণের চূড়ান্ত চুক্তি করতে হবে। একই সঙ্গে মক্কা ও মদিনায় হজযাত্রীদের বাড়ি বা হোটেল এবং পরিবহন চুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ স্থানান্তর শুরু হবে ২০ জানুয়ারি। বাংলাদেশ সরকার ও সৌদি সরকারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক হজচুক্তি সই হবে ৯ নভেম্বর। রোডম্যাপের নির্ধারিত সময়সূচির মধ্যে কোনো কাজ সম্পন্ন না হলে হজ পালন অনিশ্চিত হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সৌদি আরব।
চলতি বছরের হজযাত্রীদের প্রাথমিক নিবন্ধন শুরু হয় গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর। আগামী বছরের হজের প্রাথমিক নিবন্ধন রোববার (২৭ জুলাই) থেকে শুরু হয়েছে। চলতি বছর হজ হয়েছিল ৫ জুন। গত বছরের ৩০ অক্টোবর হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল সরকার।
আগামী হজ সামনে রেখে এখন প্যাকেজ ঘোষণা করা হচ্ছে সরকারের বড় কাজ। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তারা এখন সৌদি প্রান্তের খরচ ও দেশে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণের অপেক্ষা করছেন। আগস্টের মধ্যে হজ প্যাকেজ ঘোষণার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।
এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্যাকেজ-১ এর মাধ্যমে খরচ হয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা। প্যাকেজ-২ এর মাধ্যমে হজ পালনে খরচ হয় ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। আর বেসরকারিভাবে হজ পালনে সর্বনিম্ন খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা। এর ভিত্তিতে প্যাকেজ নির্ধারণ করেছে হজ এজেন্সিগুলো।
ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে আরও জানা যায়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় আগামী হজেও দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা নিয়ে কাজ হচ্ছে। সাধারণ প্যাকেজ হিসেবে প্যাকেজ-১ এর খরচ কমানোর চেষ্টা চলছে। চলতি বছর হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া ছিল এক লাখ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা। আগামী বছর তা দেড় লাখের নিচে নামিয়ে আনতে চায় মন্ত্রণালয়।
এ প্যাকেজের ভিত্তিতেই এজেন্সিগুলো তাদের প্যাকেজ নির্ধারণ করবে। অন্যদিকে, সরকারি প্যাকেজ-২ হবে বিশেষ প্যাকেজ। এ প্যাকেজে হজযাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে। খরচও হবে বেশি। এ প্যাকেজের খরচ হবে ৭ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা। এ প্যাকেজের বাড়ি বা হোটেল থাকবে হারাম শরিফের ৫০০ থেকে ৭০০ মিটারের মধ্যে।
চার লাখ টাকা দিয়ে রোববার (২৭ জুলাই) থেকে প্রাথমিক নিবন্ধন করা যাচ্ছে। তবে হজ এজেন্সি মালিকরা এর বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, প্রাথমিক নিবন্ধনে চার লাখ টাকা বেশি হয়ে যাচ্ছে। এতে সাড়া কম পাওয়া যাবে। কারণ, হজের এত আগে একসঙ্গে এত টাকা দেওয়া অনেকের জন্য কষ্টকর। এছাড়া প্যাকেজ ঘোষণা না হওয়ায় হজে গমনেচ্ছুরা জানতে পারছেন না, এবার হজ পালন তার সাধ্যের মধ্যে থাকছে নাকি থাকছে না।
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক বলেন, ‘হজ হচ্ছে একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বিষয়। তারা রোডম্যাপ দিয়েছে। এটা নিয়ে আমরা হাবের সঙ্গে বসেছি। হজ প্যাকেজ ঘোষণাসহ যে সব কাজ রয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে করতে হবে। একটু আগেই এবার এগুলো করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সৌদি প্রান্তের খরচের হিসাব না পাওয়া ও বিমান ভাড়া নির্ধারিত না হওয়ায় আমরা প্যাকেজটা করতে পারছি না। সৌদি প্রান্তে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কাছে চুক্তি, মিনা-আরাফায় তাঁবু ভাড়া, বাড়ি ভাড়া আগেই করতে হবে।’
সৌদি প্রান্তের খরচের হিসাব পাওয়ার পর প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘সৌদি আরবে আমাদের হজ মিশন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আমাদের এদিকেও কিছু কাজ রয়েছে। বিমান ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি রয়েছে। বিমান ভাড়া নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। খরচগুলো পেলে যত দ্রুত পারি নির্বাহী কমিটি সভায় বসে প্যাকেজ ঘোষণা করে দেবো।’
‘প্যাকেজ আগস্টের মধ্যেই করতে হবে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি’ বলেন আফতাব হোসেন প্রামাণিক।
ধর্ম সচিব আরও বলেন, ‘আমরা চাই হজের খরচ কমুক, যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ হজে যাওয়ার সুযোগ পায়। ওই প্রান্তের ও আমাদের প্রান্তের খরচ যদি কমাতে পারি তাহলে খরচ কমবে।’
‘অনেকে একটা বিশেষ প্যাকেজ নেওয়ার কথা বলেছে। তারা বলেছেন আরও কাছাকাছি থাকতে চান। ৫০০ থেকে ৭০০ মিটারের মধ্যে করা যায় কি না আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। আমরা এটা নিয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেবো। কিছু কিছু মানুষ আছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হারাম শরিফে পড়তে চান, এজন্য তারা বেশি খরচ করতেও রাজি।’
ইতোমধ্যে সৌদি সরকার আমাদের কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘আগামী বছরের হজে বাংলাদেশের কোটা এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। নুসুক মাসার প্ল্যাটফর্মে সৌদি সরকার কোটা জানিয়ে দিয়েছে। কয়েক বছর ধরে আমাদের কোটা এটাই ছিল।’
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের যুগ্ম-সচিব মো. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘এবার সৌদি সরকারের যে টাইমলাইন (রোডম্যাপ), সেটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছর থেকে এবার সময় এগিয়ে এসেছে। আমাদের হজযাত্রীদের তো মাথায় থাকে যে, হজের দু-তিন মাস আগে সব করবেন। কিন্তু সৌদি সরকার এবার ছয় মাস আগেই সব কাজ শেষ করতে চাইছে। এটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।’
তিনি বলেন, ‘এবার হাজিরা বলছেন, আরও কাছে থাকতে চাইছেন। বেশি সুযোগ-সুবিধা চান তারা। তাই প্যাকেজ-২ বিশেষ প্যাকেজ হিসেবে রাখার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। প্যাকেজ-১ এ তিন কিলোমিটারের মধ্যে হোটেলের ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা হাজিদের দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে রাখতে পেরেছি। আমাদের উদ্দেশ্য হাজিদের দূরে রাখা যাবে না। এবারও এটা আমাদের মূল উদ্দেশ্য থাকবে। আমরা হাজিদের সেবাটা নিশ্চিত করতে চাই।’
হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মহাসচিব ফরিদ আহমেদ মজুমদার বলেন, ‘সৌদি রোডম্যাপের পরিপ্রেক্ষিতে এবার কিছুটা তো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে নিবন্ধনের সময় যে চার লাখ টাকা দেওয়ার নিয়ম করা হয়েছে, এটা একটু বেশি। মানুষের তো প্রাথমিকভাবে এত টাকার প্রস্তুতি থাকে না। আমাদের দাবি ছিল এ টাকাটা দুই ভাগে নেওয়ার জন্য। প্রাথমিক টাকা যাতে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে থাকে। এটা হজযাত্রীদের দাবি।’
এবার কোরবানি ও খাবার সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে নিচ্ছে- এর বিরোধিতা করে হাব মহাসচিব বলেন, ‘এটা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের হাজিরা কেউ ৫০০ রিয়াল দিয়ে কোরবানি দেন, কেউ পনেরশ’ রিয়াল দিয়েও দেন। কোরবানিটা তো যার যার সামর্থ্যের বিষয়। একই ফরম্যাটে রাখলে তো সমস্যা দেখা দেবে।’
তিনি বলেন, ‘আর মিনা ও আরাফায় সৌদি কর্তৃপক্ষ তিন-চারদিনের খাবার দিতো, এটা নিয়েই হজযাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই। তাদের খাবারটা মানে ভালো নয়। তারা যদি এক মাস ধরে খাবারের দায়িত্ব নেয়, তাহলে হাজিদের অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটা মন্ত্রণালয়ও জানে। আশা করি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকার এ বিষয়গুলো সুরাহা করবে।’
যেভাবে করা যাবে প্রাথমিক নিবন্ধন
আগামী বছরের (২০২৬) হজের প্রাথমিক নিবন্ধন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। ২০২৬ সালে হজে গমনেচ্ছুক ব্যক্তিরা প্রাথমিকভাবে চার লাখ টাকা জমা দিয়ে হজের প্রাথমিক নিবন্ধন করতে পারছেন।
ধর্ম মন্ত্রণালয় জানায়, সৌদি সরকারের রোডম্যাপ অনুসারে এ বছরের ১২ অক্টোবরের মধ্যে হজের চূড়ান্ত নিবন্ধন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সময়ের মধ্যেই হজযাত্রীদের প্রাথমিক নিবন্ধন ও পরবর্তীসময়ে হজ প্যাকেজ মূল্যের অবশিষ্ট টাকা জমা দিয়ে চূড়ান্ত নিবন্ধন করতে হবে।
সরকারি মাধ্যমের হজযাত্রীরা ই-হজ সিস্টেম, লাব্বাইক মোবাইল অ্যাপ, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভাগীয়, জেলা ও বায়তুল মোকাররম অফিস এবং আশকোনা হজ অফিস থেকে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত নিবন্ধন করতে পারবে। তবে বেসরকারি মাধ্যমে হজ পালনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের অনুমোদিত হজ এজেন্সির মাধ্যমে নিবন্ধন করতে পারবেন।