দোকান বলতে নকিপুর গরুর হাটের পাশে ওই তো একখানি চায়ের দোকান, সরকারি জায়গায়। পরিবারের সচ্ছলতার জন্য যখন ভ্যান চালাতে বের হতেন শেখ কওছার আলী, তখন দুই বোন রেশমা আর রেহেনা মিলেই চায়ের দোকান সামলাতেন। কিশোরী সেই রেহেনা কি তখন কল্পনা করতে পেরেছিলেন, একদিন দেশের হয়ে তিনি হকিতে পদক আনবেন? কখনও কি ভেবেছিলেন শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে?
স্বপ্নের বাইরে গিয়েও রেহেনা জয় করেছেন অনেক কিছু। চীনের দাজহুতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৮ এশিয়া কাপে কাজাখস্তানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জয় করে বাংলাদেশ। রেহেনা খাতুনের সঙ্গে উপজেলার আরেক কিশোরী ষষ্ঠী রায়ও মুখর ছিলেন সেই পদকজয়ী দলটিতে। দুই সোনার কন্যার এমন সাফল্যে আনন্দিত সাতক্ষীর শ্যামনগর উপজেলা।
মেয়ের এমন সাফল্যে গর্বিত রেহেনার বাবা কওছার আলীও। ‘নিজে একসময় ফুটবল খেলতাম। তবে আয় রোজগারের চিন্তা থাকায় সেভাবে খেলাধুলায় সময় দিতি পারিনি। তবে মেয়েকে খেলার জন্য উৎসাহ দিতাম। ঘরে চাল না থাকার পরও বল কিনে দিছি। বড় মেয়ে ও ছেলেটা খেলোয়াড় হতে না পারলিও রেহেনা আমার স্বপ্নকে আকাশের উঁচুতে নিয়ে গেছে।’
আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানো রেহেনার জন্য এত সহজ ছিল না। ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা না থাকার পাশাপাশি নানা প্রতিকূলতা পদে পদে তাঁকে বাধাগ্রস্থ করেছে। তবে নিজেদের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা আর পরিবারের আকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা রেহেনাকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে।
রেহেনা খাতুন জানান, তিনি দলের হয়ে গোলবার সামলানোর দায়িত্ব পালন করেছিলেন চীনে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে আন্তঃবিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন। একটা পর্যায়ে মাধ্যমিকে ওঠার পরও সে ধারা অব্যাহত রাখেন। এ ছাড়া তাঁর বাবার খেলাধুলার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকায় তাঁকে (রেহেনা) সার্বক্ষণিক উৎসাহ দিতেন। এমনও হয়েছে, বাবা নিজেই দুই মেয়ের সঙ্গে খেলতে নেমে যেতেন। সামান্য চা বিক্রেতা হয়েও দোকানপাট বন্ধ রেখে ন্যূনতম বহুবার বিকেএসপির সাতক্ষীরা ও খুলনার ট্রায়ালে নিয়ে গিয়েছিলেন। শেষবার খুলনায় ফুটবল ও হকির ট্রায়ালে অংশ নেওয়ার পর নির্বাচকরা তাঁকে হকি দলের জন্য মনোনীত করেন।
রেহেনা জানান, তাঁর বড় বোনেরও খেলার প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে বাধ্য হয়ে তাঁকে পাত্রস্থ করতে হয়। সে কারণে বোনের খেলোয়াড়ি জীবন বেশি দূর এগোতে পারেনি। সবার দোয়া নিয়ে রেহেনা দেশের জন্য অনেক সুনাম কুড়াতে চান। অনুরোধ রাখেন, হকিতে যেন নিয়মিত জাতীয় লিগসহ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগও চালু থাকে। তাহলে অন্তত আর্থিক দিকটাতে একটু সচ্ছলতা মুখ দেখবেন।
এই হকিতেই মেয়ের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ চান তাঁর বাবা শেখ কওছার আলীও। ‘মেয়ে খেলোয়াড়দের জন্য এখনও আর্থিক কোনো নিশ্চয়তা নেই। দুর্ঘটনার কারণে দলের বাইরে চলে গেলে তাদের জন্য যাতে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়, সে ব্যবস্থা করা উচিত। আর্থিক নিশ্চয়তা পেলে রেহেনার মতো আরও অনেক মেয়ে এই উপকূলীয় এলাকা থেকে যেয়ে দেশের জন্য লড়াইয়ে আগ্রহী হবে।’