ফুলকি ডেস্ক : কম্বোডিয়ার নেতা হুন সেনের সঙ্গে একটি ফোনকল ফাঁসেই পাল্টে গেল থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন শিনাওয়াত্রার রাজনৈতিক জীবন। শুক্রবার পেতংতার্নকে পদচ্যুত করেছে দেশটির সাংবিধানিক আদালত। অভিযোগ উঠেছিল নৈতিকতা লঙ্ঘনের।
থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে সাংবিধানিক আদালতের হস্তক্ষেপ এটাই প্রথম নয়। এর আগেও আদালতের রায়ে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। এ ছাড়া, আদালত এ পর্যন্ত ১১২টি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে আছে সংস্কারপন্থী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি। দলটি ২০২৩ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল। কিন্তু সরকার গঠন করতে পারেনি। রাজতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্য নেওয়ায় পরের বছর দলটি ভেঙে দেন সাংবিধানিক আদালত। নিষিদ্ধ করা হয় এর নেতাদের।
গত জুন মাসে কম্বোডিয়ার নেতা হুন সেনের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেন পেতাংতার্ন। পরে যা হুন সেন নিজে ফাঁস করে দেন। শুক্রবার সাংবিধানিক আদালত রায়ে বলেছেন, ওই ফোনকলের মাধ্যমে পেতংতার্ন নৈতিকতার লঙ্ঘন করেছেন।
ফোনালাপে শোনা যায়, সীমান্ত বিরোধ নিয়ে হুন সেনের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা করছেন পেতংতার্ন। এক পর্যায়ে তিনি এক সেনা কর্মকর্তার সমালোচনা করেন।
হুন সেন থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পেতংতার্নের বাবা থাকসিন শিনাওয়াত্রার বন্ধু হিসেবে পরিচিত। ফোনকল ফাঁসের পর পেতংতার্ন সেটির ব্যাখ্যায় বলেন, হুন সেনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। হুন সেন ওই কথোপকথনটি গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
ফোন কলটি ফাঁসের পর বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন পেতংতার্ন ও তাঁর রাজনৈতিক দল পিউ থাই পার্টি। সে সময় পেতংতার্নের পদত্যাগের দাবি ওঠে। তাঁর জোটের সঙ্গীদের কেউ কেউ সরকার থেকে সরে দাঁড়ান।
গত জুলাইয়ে সাংবিধানিক আদালতের নয়জন বিচারকের মধ্যে সাতজন পেতংতার্নকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার পক্ষে ভোট দেন। ফলে শুক্রবারের সিদ্ধান্তটি দেশটির রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো বিস্ময় জাগায়নি। সংবিধান অনুযায়ী, এখন সংসদ সদস্যদের মধ্যে থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হবে।
বিবিসি বলছে, আদালতের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তের কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস জন্ম হয়েছে। সেটি হলো, রক্ষণশীল ও রাজতন্ত্রপন্থীরা যাদের হুমকি মনে করে আদালত সবসময় তাদের বিরুদ্ধে রায় দেন। বিশ্বে খুব কম দেশেই বিচার বিভাগের একটি শাখা রাজনীতিতে এমন কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
এখন প্রশ্ন উঠছে হুন সেন কেন তাঁর বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে হওয়া আলাপ ফাঁস করলেন। বিবিসি বলছে, বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে পেতংতার্ন শিনাওয়াত্রা সীমান্ত বিরোধ নিয়ে একটি মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, সীমান্ত বিরোধ নিয়ে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরার জন্য কম্বোডিয়ার নেতৃত্বের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করাটা অপেশাদার। হুন সেন বেশ রেগে গিয়ে এর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তিনি পেতংতার্নের মন্তব্যকে অপমান হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, এমন ঘটনাই তাঁকে সত্য প্রকাশে বাধ্য করেছে।
কিন্তু হুন সেনের সত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত থাইল্যান্ডে নতুন করে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে। কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা উসকে দেয়। গত মাসে এই দুই দেশের সীমান্তে সেনাদের মধ্যে পাঁচদিন ধরে সংঘাত চলে। এতে ৪০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।
আগের প্রধানমন্ত্রীদের পরিণতি
থাইল্যান্ডে সাংবিধানিক আদালত গঠিত হয় ১৯৯৭ সালে। তখন বলা হয়েছিল, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দল অপসারণের মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত। কিন্তু তখন থেকেই সমালোচকরা অভিযোগ করে আসছেন আদালত সেনাবাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট।
২০০৬ সালে থাকসিন শিনাওয়াত্রার অভিশংসনের জন্য আদালতে আবেদন করেছিলেন সংসদ সদস্যরা। থাকসিনের বিরুদ্ধে পরিবারিক কোম্পানির শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে স্বার্থ সংঘাতের অভিযোগ আনা হয়। তবে আদালত আবেদনটি খারিজ করে দেন। বিচারকরা বলেন, অভিযোগ প্রমাণের যথেষ্ট প্রমাণ নেই।
তবে স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ আদালত ২০০৮ সালে পদচ্যুত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সামাক সুনদারাভেজকে। সামাক একটি টেলিভিশন চ্যানেলের রান্নার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন।
২০১৪ সালে আদালত অপসারণ করেন প্রধানমন্ত্রী ইংলাক শিনাওয়াত্রাকে। জাতীয় নিরাপত্তা প্রধানকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
গত বছর অপসারণ করা হয় স্রেথা থাভিসিনকে। তাঁর বিরুদ্ধেও নৈতিকতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। তখন বলা হয়েছিল, বিচারককে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টার দায়ে কারাভোগ করা এক ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছিলেন থাভিসিন।