তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিএফপি’র মিডিয়া তালিকাভুক্ত ঢাকা জেলার একমাত্র স্থানীয় পত্রিকা

বন্ধ পাটকল, তবু খরচ ১৮৮ কোটি টাকা

- Advertisement -

খুলনা সংবাদদাতা : সাড়ে তিন বছর ধরে বন্ধ খুলনা-যশোর অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। বছরের পর বছর অচল অবস্থায় পড়ে থাকায় পাটকলগুলোর যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। এগুলোতে রয়েছেন ৯৬১ কর্মকর্তা-কর্মচারী। কাজ না থাকলেও তাদের পেছনে ব্যয় হয়েছে ১৮৮ কোটি ৪২ লাখ ৪৬ টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৫৫ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও কর্মকর্তাদের যানবাহনের জ্বালানি ব্যয় ৩২ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, পাটকলগুলো অলস পড়ে আছে। এতে যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। ভবনগুলোর আশপাশে ময়লার স্তূপ, গাছ-লতাপাতায় ছেয়ে আছে। এতে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হচ্ছে।

সরেজমিনে কয়েকটি পাটকল ঘুরে দেখা গেছে, গেটে তালা। গোডাউন বন্ধ। ভেতরের যন্ত্রপাতিতে মরিচা পড়েছে। একসময় শ্রমিকদের পদচারণায় সরগরম থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নীরবে পড়ে আছে। এসব কারখানায় সর্বশেষ শব্দ বেজেছিল ২০২০ সালের ৩০ জুনে। এরপর থেকে উৎপাদন হয়নি। তবে যন্ত্রপাতি দেখভালের নামে কর্মরত রয়েছেন ৯৬১ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে ৩৬০ কর্মকর্তা ও ৬০১ জন কর্মচারী। কাজ না থাকলেও তাদের পেছনে বছরের পর সরকারের অর্থ ব্যয় হচ্ছে।

পাটকলগুলো হলো—খুলনার আলীম জুট মিলস, ক্রিসেন্ট জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, ইস্টার্ন জুট মিলস, খালিশপুর জুট মিলস, প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস, স্টার জুট মিলস, যশোরের কার্পেটিং জুট মিলস এবং জেজেআই জুট মিলস লিমিটেড।

এর মধ্যে আলীম জুট মিলসে ২০ কর্মকর্তা ও ২৪ কর্মচারী, ক্রিসেন্ট জুট মিলসে ৭৫ কর্মকর্তা ও ১০২ কর্মচারী, দৌলতপুর জুট মিলসে ২১ কর্মকর্তা ও ৪৯ কর্মচারী, ইস্টার্ন জুট মিলসে ২৩ কর্মকর্তা ও ৫৫ কর্মচারী, খালিশপুর জুট মিলসে ৪৪ কর্মকর্তা ও ১০২ কর্মচারী, প্লাটিনাম জুট মিলসে ৫৮ কর্মকর্তা ও ১০২ কর্মচারী, স্টার জুট মিলসে ৪০ কর্মকর্তা ও ৮১ কর্মচারী, কার্পেটিং জুট মিলসে ৪২ কর্মকর্তা ও ২১ কর্মচারী এবং জেজেআই জুট মিলসে ৩৭ কর্মকর্তা ও ৬৫ কর্মচারী কর্মরত আছেন। প্রতি মাসে তাদের পেছনে ব্যয় চার কোটি ৪৮ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ তিন কোটি ৭০ লাখ ৪৭ হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ ২১ লাখ ৭৬ হাজার, জ্বালানি বাবদ এক লাখ ৬২ হাজার টাকা এবং অন্যান্য খরচ ৫৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলীম জুট মিলসের মাসে খরচ ২২ লাখ ৬৬ হাজার। এর মধ্যে বেতন বাবদ ১৭ লাখ ৬৬ হাজার, বিদ্যুৎ বিল এক লাখ চার হাজার, জ্বালানি বাবদ ১২ হাজার ও অন্যান্য খরচ তিন লাখ ৮৪ হাজার টাকা। কার্পেটিং জুট মিলসের খরচ ২৮ লাখ ১২ হাজার টাকা। বেতন বাবদ ২৩ লাখ ১০ হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৬৫ হাজার, জ্বালানি বাবদ ১৫ হাজার ও অন্যান্য খরচ চার লাখ ২২ হাজার টাকা। ক্রিসেন্ট জুট মিলসের খরচ ৮৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ৭৪ লাখ ৮৩ হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ চার লাখ ৬০ হাজার টাকা, জ্বালানি বাবদ ২২ হাজার ও অন্যান্য খরচ চার লাখ টাকা। দৌলতপুর জুট মিলসের খরচ ২৮ লাখ সাত হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ২৩ লাখ দুই হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ এক লাখ ৫৮ হাজার, জ্বালানি বাবদ ১০ হাজার ও অন্যান্য খরচ তিন লাখ ৩৭ হাজার টাকা। ইস্টার্ন জুট মিলসের খরচ ৪০ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ৩০ লাখ ২২ হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ এক লাখ ৪১ হাজার, জ্বালানি বাবদ ১৬ হাজার ও অন্যান্য খরচ আট লাখ ৬৯ হাজার টাকা। খালিশপুর জুট মিলসের খরচ ৭৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ৫৯ লাখ ৬০ হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ চার লাখ ৫২ হাজার, জ্বালানি বাবদ ১৭ হাজার ও অন্যান্য খরচ ১১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। জেজেআই জুট মিলসের খরচ ৪৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ৩৯ লাখ ২৬ হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ দুই লাখ ১৯ হাজার, জ্বালানি বাবদ ১৪ হাজার টাকা ও অন্যান্য খরচ আট লাখ ৩৯ হাজার টাকা। প্লাটিনাম জুট মিলসের খরচ ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ৬০ লাখ ৫৮ হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ তিন লাখ ৯৬ হাজার, জ্বালানি বাবদ ২০ হাজার ও অন্যান্য খরচ চার লাখ ৮১ হাজার টাকা। স্টার জুট মিলসের খরচ ৫০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ৪২ লাখ ২০ হাজার, বিদ্যুৎ বিল বাবদ এক লাখ ৮১ হাজার, জ্বালানি বাবদ ৩৬ হাজার ও অন্যান্য খরচ পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।

বন্ধ পাটকলগুলো কবে চালু হবে জানতে চাইলে প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান বলেন, ‘১৯৭২ সালে ৭৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সমন্বয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) গঠন করা হয়। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে বিজেএমসি আরও চারটি পাটকল করলে সংখ্যা দাঁড়ায় ৮২। পরের বছর ১৯৮২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বেসরকারীকরণ নীতিমালার আওতায় ৩৫টি পাটকল সাবেক বাংলাদেশি মালিকদের কাছে শর্তসাপেক্ষে হস্তান্তর, আটটির পুঁজি প্রত্যাহার এবং সাতটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। তখনও বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণে ছিল ৩২টি পাটকল। ২০০২ সালে সরকার বিজেএমসির আদমজী জুট মিলস লিমিটেড ও এবিসি লিমিটেড বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কাছে হস্তান্তর করে। পরে শর্তভঙ্গের কারণে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মালিকানায় দেওয়া পাটকলগুলোর মধ্যে ছয়টি পুনরায় গ্রহণ করে বিজেএমসিকে দেয় মন্ত্রণালয়। দুই বছর পর ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, সম্পত্তি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি-বিদ্যৎ ইত্যাদি খাতে মাসের পর মাস লোকসান দিচ্ছে সরকার। এগুলো কবে চালু হবে, তা আমার জানা নেই।’

একই বিষয়ে জানতে চাইলে দৌলতপুর জুট মিলস শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য আবুল কাশেম খোকন বলেন, ‘শ্রমিকবিহীন এসব পাটকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়া অযৌক্তিক। হয় এগুলো চালু করতে হবে, না হয় একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে অর্থ অপচয়ের মানে হয় না।’

পাটকলগুলো বন্ধ থাকায় মূল্যবান যন্ত্রপাতি ‍চুরি হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খুলনার সভাপতি কুদরত-ই-খুদা। তিনি বলেন, ‘পাটকলগুলো পাহারার নামে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ অপচয় হচ্ছে। তবু সুরক্ষা মেলেনি। চোর-পাহারাদার যোগসাজশে মিলের যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যাচ্ছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) খুলনার সমন্বয়কারী গোলাম রব্বানী বলেন, ‘বন্ধ পাটকলগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করছেন। তাই তাদের বেতন নিয়মিত দিচ্ছে সরকার। এখানে অযৌক্তিক কোনও খরচ হচ্ছে না।’

মূল্যবান যন্ত্রপাতি ‍চুরির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দৌলতপুর জুট মিলসের নিরাপত্তাকর্মী আক্তার হোসেন বলেন, ‘আমাদের মিলের কোনও যন্ত্রপাতি ‍চুরি হয়নি। আমরা এখানে নিয়মিত পাহারা দিই।’

প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলসের নিরাপত্তাকর্মী জোহরা খানম লায়লা বলেন, ‘আমাদের মিলের দুটি ভবন জরাজীর্ণ। পলেস্তারা খসে পড়ছে। নিরাপত্তাকর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। ভবনগুলো মেরামত করা হচ্ছে না। তবু আমরা জিনিসপত্র পাহারা দিচ্ছি। পাহারা না দিলে চুরি হয়ে যেতো। তবে ভেতরের যন্ত্রপাতি কী অবস্থায় আছে, তা আমাদের দেখার সুযোগ নেই। কারণ কারখানার মূল গেটে তালা।’

- Advertisement -

এ বিভাগের আরও সংবাদ