তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিএফপি’র মিডিয়া তালিকাভুক্ত ঢাকা জেলার একমাত্র স্থানীয় পত্রিকা

জাবি ঘিরে ভয়ংকর মাদক সিন্ডিকেট

- Advertisement -

জাবি প্রতিনিধি : বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘিরে মাদক ব্যবসার নিরাপদ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। অনেক শিক্ষার্থী এই মাদক সেবন ও বেচাকেনা করছেন। এমনকি মেডিকেল শিক্ষার্থীদের একটা অংশও এই মাদক সেবীদের মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে মাদকের ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এটা শিক্ষকসহ বিভিন্ন নীতিনির্ধারক মহল ও অভিভাবকদের রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে।

রাজধানীর অদূরে সাভারের জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ংকর মাদক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ছাত্র সংগঠনের এক শ্রেনীর নেতারা এই মাদক সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছেন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এক শ্রেনীর মেধাবী ছাত্র মাদক বেচাকেনায় ও এতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। লেখাপড়া করতে এসে সর্বনাশা মাদকের এই ছোবলে পড়ে মেধাবীরা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ছে। এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, অভিভাবকসহ সকল মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। মাদকের মধ্যে ইয়াবার নেশা ও ব্যবসাই হচ্ছে বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে শুরু করে গ্রামের পাড়া মহল্লায় পর্যন্ত এখন এই ইয়াবা পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। তারপরও মাদকের এই আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। কারণ হিসাবে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যারা এটা নিয়ন্ত্রণ করবেন তাদের মধ্যে এক শ্রেনীর কর্মকর্তারা এই ব্যবসায় জড়িত। রাজনৈতিক অনেক নেতাকর্মীও এর সঙ্গে জড়িত। এক শ্রেনীর নেতা নামে দল করেন কিন্তু ব্যবসা করছেন মাদকের।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো মাদক। বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমানে মরণব্যাধি ও সংক্রামকসহ নানা ধরনের রোগ ব্যাধি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো মাদক। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রায়হানুল ইসলাম বলেন, মাদকাসক্তদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। ঘর থেকে শুরু করে সকল পেশার সমন্বয়ে এবং রাজনীতিবিদদের মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে মাদক নির্মূলের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। তাহলেই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করা।

পুলিশের আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েই পুলিশ কার্যক্রম চালাচ্ছে। জেলখানায় আসামিদের মধ্যে মাদক মামলার সংখ্যাই বেশি। তাই মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একা কারো পক্ষে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে আমরা অতীতে অনেক জটিল বিষয় জয় করে এসেছি, মাদক নির্মূল করাও সম্ভব হবে।

জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ঘিরে ভয়ঙ্কর মাদক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও পাশ্ববর্তী এলাকার কয়েকটি স্পটে নিয়মিত ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক কেনাবেচা হয়। মাঝেমধ্যে মাদক ব্যবসায়ীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেও কিছুদিন পরই ছাড়া পেয়ে যায়। তবে মাদক ব্যবসায়ীরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের নাম এসেছে। আবার একশ্রেনীর ছাত্রলীগের নেতাদেরকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েও মাদক ব্যবসা করছেন অনেকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাঙামাটি এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতেন ফরিদ হোসেন ওরফে পাঞ্চু। ফরিদের কাছ থেকে দৈনিক দুই হাজার টাকা চাঁদা নিতেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই  নেতা। তবে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে গত বছরের ১৬ জুলাই নাহিদ ও জয়ের নেতৃত্বে ফরিদকে তুলে এনে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে ছাত্রলীগের নেতারা। এরপর থেকে শারীরিক অসুস্থতার জন্য ফরিদ মাদক ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন বলে এলাকাবাসী জানান। এখন আপেল মাহমুদ নামে আরেক ব্যক্তি ওই এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তবে সাব্বির হোসেন নাহিদ ও মেহেদী হাসান জয় নিজেরাও মাদক ব্যবসায়ে জড়িত। এছাড়া অন্য ব্যবসায়ীদের থেকেও মাসোহারা নেন তারা।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাঙামাটি এলাকায় মাদক ব্যবসার মূল হোতা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের চার নেতা। তাদের মধ্যে, শিমুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারীর ছেলে। বহিরাগত তিন যুবকের মাধ্যমে আশুলিয়ার পল্লিবিদ্যুত এলাকা থেকে মাদক এনে রাঙামাটি এলাকায় ভাগবাটোয়ারা করেন তারা। পরে সেখান থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে মাদক বিক্রি করে থাকেন তারা।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থীর নাম ভাঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন অনেকে। তার বড়ভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটির একজন নেতা হওয়ার পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসায়ীদের মারধরসহ নানা অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

তার মাদকসেবন ও অপরাধের সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থী। এছাড়া ওই নেতার ভাইয়ের নাম ভাঙিয়ে মাদক ব্যবসায় জড়িতদের মধ্যে মো. তাসকিন খান একজন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আমবাগান এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করেন। এর আগে, ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে আটক হন তাসকিন। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও এর আশেপাশের এলাকার অর্ধশতাধিক লোক এই মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন এবং তাদের সহযোগিতা করছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরোটলারেন্স নীতি অনুসরণ করি। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে কেউ মাদক ব্যবসায়ে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।’

বিশ্ববিদালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, ‘সন্দেহজনকভাবে শিক্ষার্থীদের তল্লাশি করার এখতিয়ার আমাদের নেই। ফলে আমাদের সামনে শিক্ষার্থীরা মাদক কেনাবেচায় জড়িত থাকলেও তাদের ধরতে পারিনা। তবে এসব বিষয়ে সবসময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবহিত করেছি। যদিও বিভিন্ন সময়ে বহিরাগত কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।’

বিশ্ববিদালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকার মাদক নির্মূলে আমরা পদক্ষেপ নিতে পারিনা। তবে আশুলিয়া থানা পুলিশকে অনেকবার অবহিত করেছি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের যারা জড়িত, তাদের বিষয়ে তথ্য দিলে ব্যবস্থা নেবো।’

র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক (মুখপাত্র) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ধর্ষণকান্ডে জড়িত মামুন ও মুরাদকে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ও পাশ্ববর্তী এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য পেয়েছি। আমাদের সদস্যরা সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত কার্যক্রম চলমান রেখেছেন। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে শীগ্রই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবো।’

ঢাকা জেলার পু‌লিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ক্যাম্পাসে পুলিশ অভিযানে গেলে অনুমতি নিতে হয়। তবে মাদকসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকায় আমরা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অভিযান চালিয়ে আসছি। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হচ্ছে না বলে তিনি জানান।

- Advertisement -

এ বিভাগের আরও সংবাদ