স্টাফ রিপোর্টার : শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সারথির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের বাঁশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচের লাগাম ধরে রাখতে একটি ফর্মূলা অনুসরণ করা হয়; তা হচ্ছে সবার আগে কম খরচে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হয়। এরপর চাহিদার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশি খরচে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হয়। একে লিস্ট কস্ট জেনারেশন বলা হয়।
বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র লিস্টকস্ট (সাশ্রয়ী তালিকা) অনুযায়ী, সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। এমনকী ভারত থেকে আমদানি করা আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের তুলনায়ও কম। বাংলাদেশের, পায়রা, রামপাল ও মাতারবাড়িকেও পেছনে ফেলেছে বাঁশখালী। গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৮.২৫৯ ইউএস সেন্টস; যা চুক্তিকালীন (ইউএস ডলার ৭৮ টাকা) গড়ে ৬.৬০ টাকার মতো ছিল।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ওই খরচ অনেকটা বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে কয়লার দাম এবং পরিবহন খরচ। তারপরেও লিস্টকস্ট তালিকায় সবার ওপরে থাকছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। আর তাই তো শীতকালে চাহিদা কম থাকার সময়েও চলছে দেদারসে। ১১ ফেব্রুয়ারি একটি ইউনিট পুরোদমে চালানো হয়।
শুধু কী লিস্টকস্ট, আঞ্চলিক লোড ব্যবস্থাপনাতেও দারুন স্বস্তি এনে দিয়েছে!
বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পরিচালক বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির বলেছেন, আঞ্চলিক চাহিদার ভারসাম্য রক্ষায় ব্যয়বহুল ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে হতো। এখন আর সেগুলোতে হচ্ছে না। এখন কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবমিলিয়ে খরচ পড়ছে ১০ থেকে ১২ টাকার মতো। আর ডিজেলে ২৫ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলে ১৫ টাকা। ডিজেলের সঙ্গে তুলনা করলে প্রতি ইউনিটের খরচ কম পড়ছে ১৩ টাকার মতো। মাসে প্রায় ৮৮ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ইউনিট প্রতি ১৩ টাকা হারে সাশ্রয় ধরলেও সরকারের মাসে সাশ্রয় হবে ১,১৪৪ কোটি টাকার ওপরে। যে কারণে বড় খরচের হাত থেকেও রক্ষা পেয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের ইতিহাসে নানান দিক থেকে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বেসরকারি একক বিনিয়োগ হিসেবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ, আবার বেসরকারি প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগেও রেকর্ড করেছে গ্রুপটি। বেসরকারিখাতে বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নেও রেকর্ড ছুঁয়েছে। প্রায় ১.৭৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থায়ন এসেছে প্রকল্পটিতে। আর এস আলম গ্রুপ নিজস্ব উৎস থেকে অর্থায়ন করেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ বেসরকারিখাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রথম ৩টি চুক্তি করে ২০১২ সালের জুনে। প্রথম দফায় সম্পাদিত ওই চুক্তিগুলো হয়, ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে। অন্যদিকে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে এস আলম গ্রুপ চুক্তিবদ্ধ করে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি।
ওরিয়নের বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসা তো দূরের কথা, কাজেই শুরু করতে পারেনি। আর ৪ বছর পর চুক্তি করে ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা দেখিয়েছে এস আলম গ্রুপ।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ২৭৫ মিটার উচ্চ রঙিন চিমনি অনেক দূর থেকেও দৃশ্যমান, যা বাংলাদেশের মধ্যে উচ্চতম। সাগর মোহনায় নির্মাণ করা হয়েছে, বিশেষায়িত জেটি, যেখানে ঘণ্টায় ২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা খালাস করা যাবে।
জাহাজ থেকে কয়লা খালাসের মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি ছেড়ে আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ করা হয়েছে। স্ক্রু আনলোডার ব্যবহার করায় কয়লা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দুটি আনলোডার দিয়ে ঘণ্টায় ২ হাজার টন কয়লা জাহাজ থেকে কোল ইয়ার্ডে নেওয়া সক্ষমতা রয়েছে।
কোল ইয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত দুটি কনভেয়ার বেল্টের সক্ষমতা রয়েছে ৪ হাজার মেট্রিক টন। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে ঢাকনা যুক্ত কনভেয়ার বেল্ট বসানো হয়েছে। কয়লা ইয়ার্ডের চারপাশে দেওয়া হয়েছে উচু নেটের ঘেরা। দুটি উন্নতমানের এফজিডি (ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন) নির্মাণ হয়েছে, অনেক আগেই। এতে করে ৯৯.৮৭ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ রোধ করা সম্ভব।
অ্যাশ সংরক্ষণের জন্য ২টি সাইলে নির্মাণ করা হয়েছে, যার প্রত্যেকটির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ২ হাজার ৬শ মেট্রিক টন। আর ৮০ একর জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে বিশাল অ্যাশপন্ড। সাইক্লোন কিংবা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতি দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে হেভি ওয়েভ প্রাচীর।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গত বছরের ১৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হয়। আর প্রথম ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) ও দ্বিতীয় ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) যথাক্রমে গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে।
বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষে বাঁশখালীর (চট্টগ্রাম) গন্ডামারা এলাকায় বৃহৎ ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। মালিকানায় রয়েছে, দেশীয় খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ, চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচ টিজি।
দেশীয় কোম্পানি এস আলমের অংশীদারিত্বের পরিমাণ ৭০ শতাংশ আর চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচ টিজির হাতে রয়েছে ৩০ শতাংশ।
এসএস পাওয়ার ওয়ান লিমিটেডের সিএফও এবাদত হোসেন ভুঁইয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। নির্মাণকালেই হাজার কোটি টাকার ওপরে ডিউটি জমা দিয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।
দেশের ভেতর থেকে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, করোনার মতো মহাসংকটের সময় যখন কর্মসংস্থান সংকট তৈরি হচ্ছিল, সেই সময়সহ টানা ৪বছর ধরে ৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর আগে প্রকল্প এলাকায় বেকারত্বের হার ছিল ৫০ শতাংশ।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এখন বেকারত্বের হার ২০ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানান এবাদত হোসেন ভুঁইয়া।
রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমকর্মীদের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘুরে দেখানো হয়। এতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ জ্বালানিখাতের অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা অংশ নেন, যাদের দেশ-বিদেশের আধুনিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেকেই সম্প্রতি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘুরে এসেছেন। বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘুরে ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা দেখে তারা মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন।
দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমকর্মীরা সরেজমিন এলে প্রশাসনিক ভবনে ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ও বিভিন্ন উত্তর দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালক এএসএম আলমগীর কবির, ভারপ্রাপ্ত সিইও ও হেড অব অপরেশন ওয়াই জিয়ানহুয়ান, সিএফও এবাদত হোসেন ভুঁইয়া, এসএমপি ডিপিডি মো. ফায়জুর রহমান ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।