স্টাফ রিপোর্টার : আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে কাজ করছে সরকার। যেটিকে বলা হচ্ছে, জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বা অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলা। ফলে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওঠানামা করবে।
বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সরকার এ ধরনের প্রাইসিং ফর্মুলা তৈরির চেষ্টা করছে৷ এ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে চিঠিও চালাচালি হয়েছে বেশ কয়েক দফা। দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ। তখন ঋণের দেওয়া শর্তে আইএমএফ জানিয়েছিল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমায় সরকার।
পরে গত বছরের ৮ অক্টোবর জ্বালানি বিভাগের সচিব নুরুল আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। তখন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দাম নির্ধারণ পদ্ধতি, জ্বালানি খাতের ভর্তুকি ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের কারণে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বা অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলা বাস্তবায়ন অনেকটা ধীরগতিতে এগোচ্ছিল। যদিও চলতি বছরের মার্চ মাসেই এ পদ্ধতি কার্যকর হওয়ার কথা৷ তবে মার্চেই সেটি কার্যকর হওয়া নিয়ে এখনো সংশয় রয়ে গেছে।
জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দামের এ ফর্মুলা বাস্তবায়নের পদ্ধতিগত কাজ করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)৷ সংস্থাটির একটি সূত্র জানিয়েছে, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের জন্য সফটওয়্যার এখনো কেনা হয়নি৷ ফলে ঠিক কবে নাগাদ পদ্ধতিটি চালু করা সম্ভব হবে সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না৷ এ নিয়ে কাজ চলছে৷ দ্রুত সরকার এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করবে৷
বিপিসি সূত্র আরও জানায়, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণের এ ফর্মুলায় জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় হিসাব করা হবে মূল্য পরিশোধের দিনের বিনিময় হার অনুযায়ী। এর সঙ্গে ডিলার কমিশন, শুল্ককর, বিপিসির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সম্ভাব্য ব্যয়, পরিচালন ব্যয় ও পরিবহন ফি এবং কিছু মুনাফা যুক্ত করে তেলের দাম নির্ধারণ করা হবে৷
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দাম পদ্ধতি চালু হওয়া খুবই দরকার৷ কেননা দেশে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী আছেন, যারা দাম বাড়ার খবরে বিক্রি বন্ধ করে তেল মজুত করে রাখেন৷ এতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই তারা অতিরিক্ত টাকা মুনাফা করতে পারেন। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা চালু হলে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ সবাই এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন৷ তখন অন্যায়ভাবে মজুত, কারসাজি বা অতিরিক্ত মুনাফা আদায়ের সুযোগ থাকবে না।
জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে নতুন এ অটোমেটেড পদ্ধতি কার্যকরের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে তার কার্যালয়ে গিয়েও তার সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলা সম্ভব হয়নি৷
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে কাজ করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকি থেকে বের করে আনাই সরকারের লক্ষ্য। বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সরকার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে। এ পরিকল্পনার আওতায় প্রতি মাসে একবার পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম সমন্বয় করা হবে।
বিপিসির ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই অর্থবছরে প্রায় ১৫ লাখ ৫১ হাজার টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে সংস্থাটি। তার মধ্যে ছয় লাখ ৮২ হাজার টন মারবান ক্রুড ও আট লাখ ৬৯ হাজার টন অ্যারাবিয়ান ক্রুড। আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ১০ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই অর্থবছরে ৪০ লাখ ৩৬ হাজার টন ডিজেল, প্রায় তিন লাখ ৩৭ হাজার টন মোগ্যাস (অকটেন ৯৫ আরওএন), চার লাখ ৭৮ হাজার টন জেট ফুয়েল, প্রায় চার লাখ ৩৬ হাজার টন ফার্নেস অয়েল ও ৩০ হাজার টন মেরিন ফুয়েল আমদানি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সংস্থাটি এসময়ে মোট পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করেছে প্রায় ৫৩ লাখ ১৭ হাজার টন, যার আর্থিক মূল্য ৫১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎস থেকে। আমদানির মাধ্যমে অবশিষ্ট চাহিদা পূরণে কাজ করে বিপিসি। অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। এর বাইরে আটটি দেশ থেকে জি টু জি (সরকারের সঙ্গে সরকারের) চুক্তির মাধ্যমে পরিশোধিত তেল আমদানি করে সংস্থাটি।
করোনা-পরবর্তীকালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে লোকসানের মুখে পড়ে বিপিসি। ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই হাজার ৭০৫ কোটি টাকা লোকসান করে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও তার আগে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছিল বিপিসি।
তথ্য বলছে, গত ৯ বছরে বিপিসির মোট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চার হাজার ২১২ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সাত হাজার ৭৫৩ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৫৫১ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছয় হাজার ৫৩৩ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৪৬ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৬৫ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ হাজার ৯২ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে শুধু ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল।
এমন মুনাফা সত্ত্বেও লোকসানের হাত থেকে বিপিসিকে বাঁচাতে ২০২২ সালে জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি করে সরকার। ওই বছরের আগস্ট মাসে জ্বালানির দাম ৪৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে চার হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা মুনাফা করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। অর্থবছর শেষে বিপুল পরিমাণ মুনাফার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা জমা দেয় বিপিসি।
সব মিলিয়ে গত ৯ বছরে মোট এক লাখ ৫৯৭ কোটি টাকা রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ২২৯ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছয় হাজার ২১৯ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নয় হাজার ২৪৮ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নয় হাজার ৯৭ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নয় হাজার ৫৯০ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১৪৬ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৭৭৮ কোটি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসি লোকসান সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয় ১৫ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা।
বিগত অর্থবছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে মুনাফা করার পরও বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে না। এমনকি বিশ্ববাজারে তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকার পরও দেশের বাজারে দাম কমছে না৷
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি জ্বালানি খাতে যৌক্তিক ব্যয় অপেক্ষা অযৌক্তিক ব্যয় বেশি হচ্ছে৷ এটি আরও বেশি চরম পর্যায়ে নিতে বিইআরসি’র (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) আইন পরিবর্তন করা হয়েছে৷ এখন দফায় দফায় তারা (সরকার) দাম সমন্বয় ও মূল্য নির্ধারণ করবে। এসব ক্ষেত্রে (স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ) সফটওয়্যারের দোহাই দেবে। এতে জ্বালানি খাতে যে লুণ্ঠন সেটি আরও চরমে পৌঁছাবে৷ এটি ভোক্তা স্বার্থের পরিপন্থি। ফলে ভোক্তার স্বার্থ হুমকিতে পড়বে।
স্বয়ংক্রিয় এ দাম ব্যবস্থা জনগণের কতটা উপকারে আসবে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দাম নির্ধারণের অনেক রকম পদ্ধতি আছে, সেটা করা কঠিন কিছু নয়৷ কিন্তু এটি কার্যকরের পর পরিবহন খাতে যে অটো রিফ্লেকশন তা যদি কার্যকর না হয় বা অটো ফেয়ার কন্ট্রোল যদি না হয়!
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেমন ৫ টাকা দাম কমলে এত টাকা ভাড়া কমবে৷ ভাড়া কমার ম্যাকানিজমটা যদি বাস্তবায়ন করা না যায় তাহলে স্বয়ংক্রিয় দাম ঠিক করলেও জনগণের কোনো লাভ হবে না৷ তার চেয়ে বরং অতিরিক্ত যে লাভ হচ্ছে, সরকারের রাজস্ব আদায় হচ্ছে সেটিই ভালো৷ মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর হাতে টাকা না গিয়ে সরকারের রাজস্ব খাতে টাকা যাওয়াই ভালো৷