তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিএফপি’র মিডিয়া তালিকাভুক্ত ঢাকা জেলার একমাত্র স্থানীয় পত্রিকা

দেশে ক্যানসারের চিকিৎসায় ভোগান্তি, খরচে নিঃস্ব মানুষ

- Advertisement -

স্টাফ রিপোর্টার : কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা সালাউদ্দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অনকোলজি বিভাগে এসেছেন কেমোথেরাপি দিতে। গত চার বছরে চিকিৎসায় তার ব্যয় হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যানসার নির্ণয় করতেই খরচ হয়ে যায় পাঁচ লাখ টাকা। জমিজমা বিক্রি ও ধার-দেনা করে জুগিয়েছেন খরচ।

তিনি বলেন, ‘শুরুতে কমপক্ষে ১০টি হাসপাতাল ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও ধরা পড়েনি। পরে স্কয়ার হাসপাতালে ধরে পড়ে। সেখানে ১৫ দিন ভর্তি ছিলাম। সার্জারি করতে হয়। ওই ১৫ দিনেই আমার সাড়ে ছয় লাখ খরচ হয়। পরে টাকা না থাকায় বাধ্য হয়ে এখানে আসি। এখানে খরচ কম হলেও অনেক ভোগান্তি অনেক। সামনের দিনে কীভাবে কেমোথেরাপি দেবো আর ওষুধের খরচ কীভাবে জোগাড় হবে সেই চিন্তায় আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’

বিএসএমএমইউ অনকোলজি বিভাগে নেত্রকোণার বাসিন্দা জুবেদা বেগমও এসেছেন কেমোথেরাপি দিতে। তিনি জানান, দুই বছর আগে পেটে টিউমার ধরা পড়ে। পরে জেলা সদর হাসপাতালে অপারেশনও করান। কিন্তু ভালো না হওয়ায় এক পর্যায়ে ক্যানসারে রূপ নেয়।
তিনি বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় এ হাসপাতালে খরচ কিছুটা কম। কিন্তু প্রতি পদে পদে ভোগান্তি। সময়মতো কেমোথেরাপি দেওয়ার শয্যা পাওয়া যায় না। আমি এখন পর্যন্ত আটটি কেমোথেরাপি দিয়েছি। একবার কেমোথেরাপির খরচ হচ্ছে ২২ হাজার টাকা। ওষুধ, থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত খরচ কমপক্ষে চার হাজার টাকা হয়। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমার পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।’

সরেজমিনে রাজধানীর শাহবাগে বিএসএমএমইউর ক্যানসার ইউনিট ও মহাখালীর ক্যানসার হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় রোগীদের নানা কষ্টের চিত্র। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দীর্ঘ লাইন। অধিকাংশ এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে। এর মধ্যে নিম্নবিত্তদের চোখে-মুখে বিষাদ-উৎকণ্ঠা। অনেকে থাকার জায়গা, চিকিৎসার খরচ মেটানো নিয়েই আতঙ্কে।

ক্যানসারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে একজন মানুষের শরীরে অনেক ধরনের ক্যানসার হতে পারে। যেমন সলিড ক্যানসার (ব্রেইন, লাং, ব্রেস্ট, পাকস্থলী, কোলন, লিভার, কিডনি, জরায়ু, ওভারি, প্রস্টেট ক্যানসার ইত্যাদি)। ব্লাড ক্যানসার (লিউকোমিয়া, লিম্ফোমা, মাল্টিপল মায়েলোমা ইত্যাদি)। দেশে বর্তমানে ১৬ থেকে ১৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে ভুগছেন। প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ নতুন রোগী যুক্ত হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ৭৫ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, দেশের প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি সমন্বিত ভি-ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র দরকার। সে অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন ১৬০টি সেন্টার। তবে বাস্তব চিত্র খুবই ভয়াবহ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে সরকারিভাবে ২২টি সেন্টারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে আরও ১০টি সেন্টার ক্যানসারের চিকিৎসা দিচ্ছে। নতুন করে হতে যাওয়া আটটি মেডিকেল কলেজেও ক্যানসার ইউনিট থাকছে। তবে নতুন সেন্টার যুক্ত হলেও যে হারে রোগী বাড়ছে, তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসায় গড়ে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৮৪০ টাকা পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এই খরচ জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৮১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধপত্র কিনতেই। ক্যানসারের প্রথম স্তরে গড়ে চিকিৎসা খরচ ৩ লাখ ৩১ হাজার ২৪৩ টাকা। আর দ্বিতীয় স্তরে গড় খরচ ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৫ টাকা।

মরফিনের অভাবে যন্ত্রণার মৃত্যু
ক্যানসারের ব্যথা উপশমের সবচেয়ে ভালো ওষুধ মরফিন। দেশে ব্যথানাশক এ ওষুধ দুষ্পাপ্য হয়ে পড়েছে। লাভ কম হওয়ায় ওষুধটি উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবের বরাত দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে ব্যথানাশক এ ওষুধ বছরে দরকার কমপক্ষে ৬০০ কিলোগ্রাম। রোগীরা পাচ্ছেন ২৩ কিলোগ্রাম, যা প্রয়োজনের মাত্র ৪ শতাংশ। মরফিনের অভাবে বিপুলসংখ্যক রোগী যন্ত্রণা নিয়ে মারা যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএসএমএমইউতে একটি লিনিয়ার এক্সেলেটর রেডিওথেরাপি মেশিন আছে। এছাড়া জরায়ুমুখের চিকিৎসার জন্য ব্রাকিথেরাপি মেশিন আছে একটি। কেমোথেরাপির জন্য একটি কেমো ডে কেয়ার সেন্টার আছে, সেখানে ২০ জনের মতো রোগী প্রতিদিন থেরাপি নিতে পারেন। এখানে ৬০টির মতো বেড আছে ওয়ার্ডে।

এ বিষয়ে জানতে বিএসএমএমইউর অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, মদ্যপান করা, চাবানো তামাক (পান, জর্দা, সুপারি খাওয়া) এসবের কারণে অনেক মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন।

খাওয়া-দাওয়ার সমস্যার কারণে আমাদের পরিপাকতন্ত্রের ক্যানসার, কিডনির ক্যানসার এসব বেড়ে যাচ্ছে। আর কিছু ক্যানসার জেনেটিক কারণে হয়। তাতে কিছু করার থাকে না। একটু সুযোগ পেলেই আক্রমণ করে বসে। জরায়ুমুখের ক্যানসারের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। ফলে এটি কমে আসবে।’

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘জরায়ুমুখের ক্যানসারের বিষয়ে অনেক নারী লজ্জায় কাউকে বলতে পারেন না। সহ্য না করতে পেরে এরপর বলেন। তখন একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে আসে, তাদের আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। ক্যানসার তাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। অথচ শুরুতে এলে সহজেই এ রোগ নিরাময় করা সম্ভব হবে। রেডিও, কেমো ও হরমোন থেরাপির মাধ্যমে শতভাগ কিওর করা সম্ভব। তাই শুরুতে শনাক্ত করা এক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজন অনেক বেশি।’

ভেজাল খাদ্য গ্রহণে ক্যানসার হচ্ছে, এ বিষয়ে কী করা উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত ভেজাল খাদ্য নিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। ভেজাল খাদ্য পাওয়া গেলে প্রয়োজনে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়ার আইন করতে হবে। কারণ তাদের কারণে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। তাহলে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিলে ভুল কিছু হওয়ার কথা না।’

যন্ত্রপাতির অনেক বেশি সংকট জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্যানসার চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হচ্ছে রেডিওথেরাপি মেশিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি মেশিন দরকার। সে হিসেবে আমাদের ১৬ কোটি মানুষের জন্য ১৬০টি মেশিন থাকা দরকার। আর চিকিৎসাসেবা সহজ করতে প্রয়োজন ২০০টি মেশিন। তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশে আছে মাত্র ২০টি মেশিন। এর অর্ধেকের বেশি আবার নষ্ট। বিএসএমএমইউতে একটি মেশিন আছে। সব সময় সচল থাকে না, মাঝে মাঝে নষ্টও থাকছে। আরেকটি মেশিন আনার প্রক্রিয়া চলছে, তবে কখন আসে জানা নেই।’
ওষুধের ব্যয় অনেক বেশি, তবে আগের চেয়ে কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেকগুলো কোম্পানি এখন ক্যানসারের ওষুধ তৈরি করছে। এজন্য ব্যয় কিছুটা কমেছে। আগে যেখানে ৩০ হাজার লাগতো সেখানে ১০ হাজার লাগছে। তবে কাঁচামাল দেশে তৈরি করা গেলে আরও খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব।’

পরিস্থিতি বুঝে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হলে সবার আগে হাসপাতাল ও জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রোগী নিবন্ধন জরুরি, যা এখন পর্যন্ত দেশে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে চেষ্টা করছে। এটিও সন্তোষজনক নয়।- বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক
‘বাংলাদেশ ফ্রান্স, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসে। সরকারকে বলবো যেন ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখে। আগে বিএসএমএমইউতে কিছু ওষুধ ফ্রি দিতো চাহিদা অনুযায়ী। আমরা গরিব রোগীদের ফ্রিতে দিতে পারতাম। প্রধানমন্ত্রীর একটি তহবিল আছে সেখান থেকে কিছু রোগীকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ অফিস থেকে এলে সেক্ষত্রে কিছু পায়। তবে এসব অপ্রতুল। ভারতে কাঁচামাল, ওষুধ নিজেরা উৎপাদন করে। আর জনগুরুত্বপূর্ণ হলে সেটি সরকার কিনে নিয়ে কম দামে মার্কেটে ছেড়ে দেয়। এর মধ্যে ক্যানাসারের ওষুধ একটি। এ কারণে যেটি আমাদের দেশে ১০ হাজার টাকা সেখানে এক হাজার টাকায়ই পাওয়া যায়।’
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হলে সবার আগে হাসপাতাল ও জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রোগী নিবন্ধন জরুরি, যা এখন পর্যন্ত দেশে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে চেষ্টা করছে। এটিও সন্তোষজনক নয়।’

বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসায় কী ধরনের বৈষম্য আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘদিনের চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। প্রতিবছর বাংলাদেশে দুই লাখ নতুন রোগী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ৫০ হাজারকে কিওর করা সম্ভব হচ্ছে। সবাইকে ভালোভাবে চিকিৎসা না দিতে পারাটাও বৈষম্য। এছাড়া গরিব রোগীদের যথাযথ চিকিৎসার আওতায় না আনতে পারাটাও বৈষম্য।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ওষুধ সরবরাহ ও চিকিৎসা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ক্যানসার রোগীদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া সরকারের কাছে আকুল আবেদন, যাতে সমাজকল্যাণ ফান্ড থেকে যে ৫০ হাজার করে দেওয়া হতো তা এক লাখ টকায় উন্নীত করুক। এতে ক্যানসার রোগীদের কিছুটা সুবিধা বাড়বে।’

‘অনেক রোগীদের বিভিন্ন জায়গা থেকে শহরে যাতায়াত করা লাগে। তাদের একটি ক্যানসার কার্ড করে দিয়ে ৫০ শতাংশ যাতায়াত ভাড়া যদি কমিয়ে দেওয়া যায় তাহলে দূর থেকে এসে চিকিৎসা নিতে পারবে। এ বিষয়গুলো বৈষম্য কমাবে।’
তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকার ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নতি করার ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আটটি বিভাগে আলাদা করে ক্যানসারের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান করে দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এতে যারা চিকিৎসা পাচ্ছে না তারাও চিকিৎসার আওতায় আসবে।

 

- Advertisement -

এ বিভাগের আরও সংবাদ