স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করা এতটাই লোভনীয় হয়ে উঠেছে যে পদোন্নতি নিতে চান না প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা (পিও)। এমনকি সহকারী সচিব (ক্যাডারবহির্ভূত) পদে পদোন্নতি না দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণির (দশম গ্রেড) এও-পিওরা লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছেন।
পদোন্নতি না নিলে নিচের তৃতীয় (১৩ থেকে ১৬ গ্রেড) ও চতুর্থ শ্রেণির (১৭ থেকে ২০ গ্রেড) কর্মচারীদের পদোন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাই পদোন্নতি না নেওয়ার বিষয়টিকে ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে অনুশাসন দিয়েছেন সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব।
সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে চাকরি করা কোনো কোনো কর্মকর্তার কাছে পদোন্নতির চেয়েও লোভনীয়। কারণ এটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। এখানে অন্য মন্ত্রণালয়ের চেয়ে চাকরির সুযোগ-সুবিধা যেমন বেশি, একই সঙ্গে এখানে অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগও বেশি। তাই ‘সুবিধায়’ ডুবে এখানকার এও-পিওদের চাকরি জীবনের কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতিতেও অনীহা।
কোন কোন কর্মকর্তা পদোন্নতির মাধ্যমে সম্মান ও বেতন বৃদ্ধির চেয়ে এ মন্ত্রণালয়ে চাকরি করাটাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। তাদের উদ্দেশ্য মহৎ নয় বলে মন্তব্য করেন সুরক্ষা সেবা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জানা যায়, এও-পিওরা পদোন্নতি নেবেন না বলে আবেদন দেন। এরপর গত ৯ সেপ্টেম্বর সুরক্ষা সেবা বিভাগে কর্মরত ১৭ জন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী তাদের বিরোধিতা করে পদোন্নতি নিশ্চিতে সিনিয়র সচিবের কাছে আরেকটি আবেদন দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি পদোন্নতি না নেওয়ার বিষয়ে একটি অনুশাসন দেয় সুরক্ষা সেবা বিভাগ।
সেখানে বলা হয়, সুরক্ষা সেবা বিভাগে কর্মরত কিছু সংখ্যক প্রশাসনিক কর্মকর্তা/ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ফিডার পদধারী (পদোন্নতির আগের পদ) হিসেবে সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির জন্য নাম আসা সত্ত্বেও পদোন্নতি গ্রহণ করবেন না বলে আবেদন দাখিল করেন। সহকারী সচিব পদে তাদের পদোন্নতি গ্রহণ না করার কারণে প্রশাসনিক কর্মকর্তা/ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির জন্য ফিডার পদধারী হিসেবে সুরক্ষা সেবা বিভাগে কর্মরত সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর/কম্পিউটার অপারেটর/অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকদের পদোন্নতি প্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।
অনুশাসনে আরও বলা হয়, ‘এ পদধারীদের মধ্যে অনেক কর্মচারী পদোন্নতিযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পদ খালি না থাকায় তারা প্রশাসনিক কর্মকর্তা/ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে ফিডার পদধারী হিসেবে পদোন্নতিযোগ্য সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর/ কম্পিউটার অপারেটর/অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি ও কর্মস্পৃহা বিনষ্ট হচ্ছে বলে তারা আবেদন করেছেন এবং এ বিষয়ে তারা ন্যায়সঙ্গত বিচার প্রত্যাশা করেছেন।’
এ অবস্থায় সচিবালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের পদোন্নতির ধারা গতিশীল এবং দাপ্তরিক কার্যক্রমে অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে পদোন্নতিযোগ্য কর্মচারীদের ‘পদোন্নতি না নেওয়ার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে অনুশাসন জারি করা হলো। এ অনুশাসন সুরক্ষা সেবা বিভাগের সব কর্মচারীর (প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা) জন্য প্রযোজ্য হবে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এও-পিওদের পদোন্নতি হলে সহকারী সচিব হিসেবে অন্য মন্ত্রণালয়ে তাদের পদায়ন হবে। হয়তো কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন হতে পারে। ভালো মন্ত্রণালয়ে পদায়ন হলেও ভালো ডেস্ক নাও পেতে পারেন। এমন আশঙ্কা রয়েছে অনেকের মধ্যে। তাই তারা পদোন্নতি নিতে চান না।
এছাড়া এ মন্ত্রণালয় থেকে অফিস সহায়ক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিদেশে পোস্টিংয়ের সুযোগ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তারা চাকরি জীবনে দুবার বিদেশে পোস্টিং পেতে পারেন। একবার বিদেশে পোস্টিং হওয়ার চার/পাঁচ বছর পর আবার যেতে পারেন। প্রতিবার তারা বিদেশে পোস্টিংয়ে চার বছর থাকতে পারেন। এটা বেশ লোভনীয়। সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেলে তো তাকে অন্য দপ্তরে চলে যেতে হবে। এমনটা জানান এও-পিওরা।
বিভাগের প্রশাসন অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘কেউ যদি পদোন্নতি না নেন তাহলে তার পদটি খালি হয় না। এতে তার পেছনে যিনি আছেন, তার পদোন্নতি আটকে যায়। আমাদের পদগুলো তো সীমিত। একজনের ইচ্ছা হলো পদোন্নতি নেবেন না, এটা তার অধিকার আছে, কিন্তু তিনি তো আরেকজনের অধিকার নষ্ট করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করি, আমরা যে কয়টা জিনিসের জন্য চাকরি করি এর মধ্যে পদোন্নতি একটা বিষয়। এটা আমার এক ধরনের স্বীকৃতি। এতে আমার বেতন বাড়বে, পদমর্যাদা বাড়বে, আমি মানসিক শান্তি পাবো। কিন্তু কী এমন থাকবে যে কেউ পদোন্নতি নিতে চাইবে না! নিশ্চয়ই সেখানে অন্য রকম কিছু আছে। আমরা তো সেটাকে উৎসাহিত করতে পারি না।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) সেখ ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘পদোন্নতির যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতি নেবেন না বলে প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা আমাদের কাছে আবেদন দিয়েছেন। কিন্তু তারা পদোন্নতি না নিলে তাদের নিচে যারা পদোন্নতি প্রত্যাশী আছেন তারা বঞ্চিত হবেন। অন্যদিকে নিচে যারা রয়েছেন তারাও একটি আবেদন দিয়েছেন যেন তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় সচিব স্যার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, পদোন্নতি নিতে হবে। পদোন্নতি নেবেন না বলে তারা যেটা বলেছেন সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়টি আমরা তাদের জানিয়ে দিয়েছি। পরবর্তীসময়ে এটাই অনুসরণ করা হবে।’
এও-পিওদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী, সরকারি কর্ম কমিশনের সুপারিশ নিয়ে তাদের নন-ক্যাডার সহকারী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও পিএসসির সুপারিশ সাপেক্ষে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, কম্পিউটার অপারেটর, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকদের এও-পিও পদে পদোন্নতি দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রায় তিন হাজার প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রয়েছেন। এসব কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য ক্যাডারবহির্ভূত মাত্র ২৯২টি সহকারী সচিব, ৭৮টি সিনিয়র সহকারী সচিব এবং ৯টি উপসচিব পদ রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় পদ কম থাকায় বেশির ভাগ দ্বিতীয় শ্রেণির (দশম গ্রেড) কর্মকর্তাকেই একই পদ থেকে অবসরে যেতে হয়। তাই এটা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে অনেক এও-পিওদের মধ্যে।
‘বাংলাদেশ সচিবালয় (ক্যাডারবহির্ভূত গেজেটেড কর্মকর্তা এবং নন-গেজেটেড কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৪’ অনুযায়ী সচিবালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, কম্পিউটার অপারেটর, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকসহ বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। নন-ক্যাডার উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, সহকারী সচিব পদেও পদোন্নতি দেওয়া হয় এ বিধিমালার ভিত্তিতে।
বিধিমালা অনুযায়ী সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে সাত বছর চাকরি করতে হয়। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেতে ফিডার পদে পাঁচ বছর চাকরি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।