স্টাফ রিপোর্টার : শেখ হাসিনার শাসনামলে সাভার ও আমিনবাজার এলাকার দখল, চাঁদাবাজি, সহিংসতার এক নরকরাজ্যে পরিণত করেছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অনেকেই ভেবেছিলেন এই বুঝি স্বস্তি ফিরে এলো! তবে বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং আওয়ামী লীগের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের হাতবদল হয়েছে। আর সেখানে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা। হেমায়েতপুর-আমিনবাজার এলাকায় আবির্ভাব হয়েছে ‘নতুন সম্রাট’ মোশারফ হোসেন মুশার। এক সময়ে আওয়ামী লীগ ঘেঁষা এ নেতা রাতারাতি ভোলপাল্টে এখন বিএনপি নেতা সাজার চেষ্টা করছেন। এলাকায় শুরু করেছেন দখল-চাঁদাবাজি।
জানা গেছে, গত ৭ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে সাভারের অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা হেমায়েতপুর এলাকার ফুটপাথ, ভ্রাম্যমাণ মার্কেট, কুলিবিট, বাসস্ট্যান্ড, বাজার-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ কমিটি, গার্মেন্টস ঝুট, হাউজিং ব্যবসাগুলো দখলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন মুশার বিরুদ্ধে। এই মোশারফ হোসেন মুশা ও তার পাঁচ ভাই মিলে পুরো এলাকার দখল নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা ওই এক মাসের মধ্যেই নিজস্ব বাহিনী দিয়ে একাধিক তাণ্ডব চালিয়েছেন বলে জানা যায়।
এলাকাবাসী জানায়, সম্প্রতি একটি দখলের ঘটনায় বাধা দিতে গিয়ে মুশার লোকজনের হাতে বেধড়ক মারধর ও কুপিয়ে জখমের শিকার হন এস আলম কাউন্টার মাস্টার হাসমত, আরিফ, ফিট ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম, মেহেদি, আব্দুল মজিদ। পরে তারা সবাই হাসপাতালে ভর্তি হন।
সরেজমিনে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে জানা যায়, এক্সিম ব্যাংক থেকে এনআরবি ব্যাংক পর্যন্ত সিংগাইর সড়কে থাকা কয়েকশ দোকান থেকে প্রতি দিন ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা করে চাঁদা তুলছে মোশারফের লোকজন। একইভাবে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে জয়নাবাড়ি সড়কে ও হেমায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিতে নির্মিত মার্কেটে শতাধিক দোকান থেকে প্রতিদিন ২শ থেকে ১ হাজার টাকা তোলা হচ্ছে। স্কুলের নামে তোলা টাকা চলে যাচ্ছে মোশারফের কাছে। বাদল হোসেন নামের এক ফুটপাথ দোকানি বলেন, মোশারফের লোকজন দিনের বেলায় চাঁদামুক্ত করতে মাইকিং করেন, আবার সন্ধ্যা হলে তারাই দোকানপাট থেকে চাঁদা তোলেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি বিলুপ্ত করলেও হেমায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে সভাপতি হয়েছেন মোশারফের ভাই শরিফ ইসলাম। ওই এলাকাটির লক্ষাধিক ইন্টারনেট ও ডিশ সংযোগ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন মোশারফ ও তার ভাই রকিব, রাসেল।
সম্প্রতি আমিনবাজার এলাকার টিমটেক্স গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা দখল করে মোশারফের ভাই শরিফ। চেষ্টা চলছে তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের এজেআই গ্রুপ, ডেকো গ্রুপসহ আরও বেশকিছু কারখানার ঝুট দখলের। হেমায়েতপুরে এক সময় ডিস ব্যবসা জাকির হোসেন নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন তা দখলে নিয়েছেন ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি মেহেদি হাসান। আগে আওয়ামী লীগের আনিস আহমেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বর্জ্য পরিচ্ছন্নতার কাজের নিয়ন্ত্রণ এখন রাসেল, রাকিব, শরিফ, মোশারফের হাতে।
এসব বিষয়ে মোশারফ হোসেন মুশা বলেন, আমি কারো দখলবাজির দায় নেব না। আমি কোনো চাঁদাবাজি ও দখলবাজির সঙ্গে জড়িত নই। চাঁদাবাজি বন্ধে আমি মাইকিং করেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোশারফ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মনজুরুল আলম রাজীব ও তার ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল আলম সমরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাক চালক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আলী বলেন, মুশা আমাদের ইউনিয়ন থেকে ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। আমাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মৃত সদস্যদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও সে একজনকেও কোনো টাকা পয়সা দেয়নি।
মৃত মানুষদের টাকাগুলো সে খেয়ে বসে আছে। এ পর্যন্ত ১৬৯ জন মৃত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলেও সে কাউকে কোনো টাকা পয়সা দেয়নি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ সভার মাধ্যমে আমরা তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিই। সে এখন বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের কেউ নন। দুর্নীতির দায়ে দুই-তিন দিনের মধ্যে তাকে আমরা পূর্ণাঙ্গ বহিষ্কার করব।
এ ছাড়াও ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন বাসা বাড়িতে মোশারফের নেতৃত্বে লুটতরাজের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। স্থানীয়দের মাঝে চলছে আলোচনা সমালোচনা। মুশার অনৈতিক কর্মকাণ্ড, দখলবাজি এবং চাঁদাবাজিতে অনেকটা অসহায় স্থানীয়রা। মুশার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে তাকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি স্থানীয়দের।