তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিএফপি’র মিডিয়া তালিকাভুক্ত ঢাকা জেলার একমাত্র স্থানীয় পত্রিকা

নতুন-পুরোনো শিক্ষাক্রমের মিশেলে মাদ্রাসায় ‘তালগোল’

- Advertisement -

স্টাফ রিপোর্টার : নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথমবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালে। দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ওপর এ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে। তবে মাদরাসা বোর্ডের অধীনে সারাদেশে দাখিল পরীক্ষা নেওয়া হবে মিশ্র পদ্ধতিতে।

দাখিলে ১১টি বিষয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা হবে। বাকি পাঁচটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে আগের নিয়মে। তাদের ফলাফলও তৈরি হবে সম্পূর্ণ আলাদা। মার্কশিটে নতুন শিক্ষাক্রমের ফল থাকবে একটি অংশে, আরেকাংশে থাকবে পুরোনো শিক্ষাক্রমের ফল।

মাদরাসার শিক্ষক-অভিভাবকরা বলছেন, অর্ধেক নতুন অর্ধেক পুরোনো শিক্ষাক্রম রাখলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হিমশিম খাবে। মিশ্র পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলে বড় ফল বিপর্যয়ও ঘটতে পারে। তাছাড়া পরবর্তীসময়ে যখন মিশ্র পদ্ধতি বাতিল হবে, তখন এ শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপাকে পড়বেন। তাদের মার্কশিট বা রিপোর্ট কার্ড কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড সূত্র বলছে, মাদরাসার বিশেষায়িত পাঁচটি বিষয়ের পাঠ্যবই এখনো নতুন শিক্ষাক্রমে লেখা সম্ভব হয়নি। এজন্য দুই বছর (২০২৬ ও ২০২৭ সাল) মিশ্র পদ্ধতিতে দাখিল পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারপর (২০২৮ সাল) থেকে পুরো পরীক্ষা নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ অনুযায়ী— ২০২৩ সাল থেকে কার্যক্রমভিত্তিক নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার। চলতি বছর সাতটি শ্রেণিতে নতুন এ শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মাদরাসায়ও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। নতুন নিয়মে মাদরাসায় দশম শ্রেণিতে থাকবে মোট ১৬টি বিষয়। এর মধ্যে ১১টি বই সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে হুবহু মিল থাকবে। বাকি পাঁচটি বই মাদরাসার বিশেষায়িত। যেগুলো এখনো নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা ও সম্পাদনার কাজ শুরুই হয়নি। এ কাজ শেষ করতে দু-তিন বছর লাগতে পারে। সেসময় পর্যন্ত দাখিলে মিশ্র পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি)।

মিশ্র পদ্ধতিতে পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা

স্কুলপড়ুয়ারা দশম শ্রেণিতে ১১টি বই পড়বে। সবগুলোই নতুন শিক্ষাক্রমের। সেগুলোর ওপর দেবে এসএসসি পরীক্ষা। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা স্কুলপড়ুয়াদের মতো ১১টি বই তো পড়বেই, সঙ্গে তাদের পড়তে হবে আরও পাঁচটি বিশেষায়িত বই। এটা তাদের ওপর এমনিতেই বাড়তি চাপ। তার ওপর অর্ধেক নতুন, অর্ধেক পুরোনো শিক্ষাক্রমে পড়তে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলার ভয়ে শিক্ষার্থীরা। আর ফল বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষকরা।

গাজীপুরের মদিনাতুল উলুম কামিল মাদরাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও কোরআনের হাফেজ রেজওয়ান রুহানি। ২০২৬ সালে তিনি নতুন নিয়মে প্রথমবার দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেবেন। জানতে চাইলে রেজওয়ান রুহানি বলেন, ‘নতুন পদ্ধতি আমাদের কাছে একেবারে অপরিচিত। শিক্ষকরাও ভালোমতো বুঝিয়ে দিতে পারছেন না। সেখানে ১১টি বিষয়ে নতুন, পাঁচটি বিষয়ে পুরোনো নিয়মে পরীক্ষা দেওয়া কষ্টসাধ্য হবে। আমরা হয় নতুন অথবা পুরোনো নিয়মে পরীক্ষা চাই।’

ঢাকা আলিয়া মাদরাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল আলিম বলেন, ‘সরকার যদি নতুন নিয়ম চালু করতে চায়, তাহলে সব বিষয়ে নতুন হওয়া উচিত। দুই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিলে অবশ্যই সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা চাই, নতুন নিয়মে পুরো পরীক্ষা নেওয়া হোক। যদি প্রস্তুতি না থাকে তাহলে দাখিলে আরও দুই বছর পর নতুন নিয়মে পরীক্ষা নেওয়া হোক।’

জানতে চাইলে ঢাকা আলিয়া মাদরাসার একজন সহযোগী অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম ভালো নাকি মন্দ, তা বলাটা আমরা পক্ষে সমীচীন নয়। সরকার যেহেতু মাদরাসায়ও নতুন শিক্ষাক্রম পুরোদমে চালু করছে, তাহলে পুরোটাই নতুন পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। তা নাহলে শিক্ষার্থীরা বুঝে উঠতে পারবে না। ফলাফলও খুব খারাপ করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এমনিতেই চাকরির বাজারে অনেক পিছিয়ে। মেধাবী হওয়া সত্ত্বে শুধু মাদরাসায় পড়ালেখা করার কারণে তারা বিভিন্ন সেক্টরে গিয়ে চাকরিবঞ্চিত হয়। সনদে মাদরাসা লেখা দেখলেই তাদের চাকরি দেওয়া হয় না। এখন যদি দুই পদ্ধতিতে তাদের পরীক্ষা হয়, মার্কশিট-সার্টিফিকেটে সেটা লেখা থাকে, তাহলে আরও বিপদে পড়বে।’

এনসিটিবির চাপে ‘নাখোশ’ মাদরাসা বোর্ড

মিশ্র পদ্ধতিতে দাখিলের মতো পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে একমত নন মাদরাসা বোর্ডের কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) জোরাজুরিতে চাপ রয়েছে। এনসিটিবি ২০২৬ সালে এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষায় নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে মরিয়া। অথচ মাদরাসায় তা বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নেই। ফলে এ নিয়ে কিছুটা ‘নাখোশ’ মাদরাসা বোর্ড। তবে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে নাম-পরিচয় প্রকাশ করে মন্তব্য করতে চাননি কোনো কর্মকর্তা।

মাদরাসা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের দুজন কর্মকর্তা জানান, অনেক আগে থেকেই এনসিটিবিকে মাদরাসার বই নতুন শিক্ষাক্রমে রূপান্তরের তাগিদ দেওয়া হয়েছিল বোর্ড থেকে। তারা মাদরাসাকে গুরুত্বই দেননি। এখন এসএসসির সঙ্গে দাখিল পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি না থাকলেও মাদরাসা বোর্ডকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতির মুখে পড়বে।

জানতে চাইলে মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ফেরদাউছুর রহমান বলেন, ‘সব বিষয় নতুন শিক্ষাক্রমে রূপান্তর করে পাবলিক পরীক্ষা (এসএসসি ও দাখিল) নিলে ভালো হতো। এতে শিক্ষার্থীদের সুবিধা হতো। দুই পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলে সমস্যা তো কিছুটা হবেই। এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। আমাদের এখানে কিছু করার নেই। আমরা বাস্তবায়নে কাজ করছি।’

মাদরাসার বই রূপান্তর কবে?

মাদরাসার বিশেষায়িত বইগুলো নতুন শিক্ষাক্রমে রূপান্তর নিয়ে এনসিটিবি এখনো সেভাবে এগোতে পারেনি। তারা এখন ব্যস্ত দশম শ্রেণির বই নিয়ে। এ কাজ শেষ হতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে। এরপর মাদরাসার বই রূপান্তর নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করবে এনসিটিবি। মাদরাসা বোর্ডও এনসিটিবির সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে সময় পার করছে।

মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ফেরদাউছুর রহমান বলেন, ‘বই রূপান্তর কখন হবে, সেটা এনসিটিবি জানে। তারা আমাদের কোনো কাজে সহযোগিতা চাইলে সেটা করবো। বই তৈরির আগ পর্যন্ত আগের বইয়ে পড়াতে বাধ্য আমরা।’

নতুন-পুরোনো শিক্ষাক্রমের বই

নতুন শিক্ষাক্রমে ১১টি বই পড়ছে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। এগুলো দশম শ্রেণিতেও থাকবে। মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও এগুলোর সঙ্গে আরও পাঁচটি বিশেষায়িত বই পড়বে।

রূপান্তর করা ১১টি বই হলো—বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ, বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠ, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, শিল্প ও সংস্কৃতি, ইসলাম শিক্ষা (মাদরাসায় ইসলামের ইতিহাস)।

পুরোনো পাঁচটি বিশেষায়িত বই হলো—কোরআন মাজিদ ও তাজভিদ, হাদিস শরিফ, আকায়েদ ও ফিকহ, আল লুগাতুল আরাবিয়াতুল ইত্তেসালিয়া, কাওয়াইদুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ।

- Advertisement -

এ বিভাগের আরও সংবাদ