স্টাফ রিপোর্টার : মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন। ছলচাতুরী। এনআইডি সংশোধন। বাবা-মায়ের নাম পরিবর্তন। বয়স ও যুদ্ধক্ষেত্রে সাক্ষীতে কারসাজি। স্থানীয় এমপিদের সুপারিশ। এমন নানা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠিয়েছিলেন ৮ হাজারের বেশি। খসড়া যাচাই-বাছাইয়ে ধরা পড়ে অনেক অসঙ্গতি। নড়েচড়ে বসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। পরে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতে যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।
আইনজীবীরা বলছেন, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি সুবিধা ভোগ করা অপরাধ। আর ফৌজদারি আইনের ৪১৬ ধারা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে তাও অপরাধ। এ ছাড়া মিথ্যা তথ্য দেয়ার জন্য ৩ বছরের জেল এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিলে ৭ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। হতে পারে অর্থদণ্ডও। মন্ত্রণালয় যদি চায় তাহলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে সংখ্যায় বেশি হওয়ায় সেটা সময় সাপেক্ষ হবে।
জানতে চাওয়া হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ভুয়া তথ্য দিয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, তারা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তাদের অবশ্যই শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। তারা পার পেয়ে গেলে, এমন কাজ অন্যরাও করতে উৎসাহিত হবেন। ভুয়াদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ফেরত এনে তারা অতীতে যত সুবিধা পেয়েছেন সব বাতিল করতে হবে। সন্তানরা চাকরি পেলে তাও বাতিল করতে হবে। আর মুক্তিযুদ্ধ না করেও কীভাবে তারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আসলেন? এই সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত। এই ধরনের গাফিলতি মোটেও মেনে নেয়া যায় না।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তির বিষয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক সম্প্রতি বলেছিলেন, ভুয়া প্রমাণ হওয়ায় ৮ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। শাস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এখন আমরা মন্ত্রণালয় চালাবো নাকি আদালতের বারান্দায় বারান্দায় দৌড়াবো। তবে শুক্রবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ভুয়াদের তালিকা বাতিলের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমরা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। আমরা মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মামলা করে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ভুয়া শব্দটি অসম্মানজনক। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হয়েছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তি নিশ্চিতে মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে হবে। ‘আমরা মন্ত্রণালয় চালাবো নাকি আদালতের বারান্দায় বারান্দায় দৌঁড়াবো’ এমন কথা যদি মন্ত্রী বলে থাকেন, তাহলে এটা দুঃখজনক। মন্ত্রীতো আর কোর্টে যাবেন না। মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব আইনজীবী আছে তারা লড়বেন। আর যারা বিপুল পরিমাণ টাকা খেয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করেছে তাদের আগে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এদের সকলকে জেলে দিতে হবে। উপজেলা জেলা থেকে যারা এদেরকে সুপারিশ করেছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর অবশ্যই এই প্রতারকদের সকল সুবিধা বাতিল করে তাদের দেয়া টাকা ফেরত আনতে হবে। কয়েকজন সচিব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছিল। পরে ধরা পড়লে তাদের সনদ বাতিল করা হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলে আমি তাদের রোষানলে পড়ি। ওই চক্র আমার একটি বিল ৭ বছর আটকে রেখেছিল। এই হলো অবস্থা তাদের বিষয়ে বলে লাভ নেই। আমার অপরাধ ছিল কেন আমি ওই সচিবদের বিরুদ্ধে বললাম।
৫ সচিবের আজো বিচার হয়নি-
সাবেক স্বাস্থ্য সচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন সচিব এ কে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদারের বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ নেয়ার অভিযোগ ছিল। পরে সরকারের এই পাঁচ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ২২শে সেপ্টেম্বর তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। বাতিল করা হয় সাবেক সচিব এবং প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তৎকালীন বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের সনদও। সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর তাদের স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। তবে ৭ বছরেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল। তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।