স্টাফ রিপোর্টার : মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার সাতঘরিয়া গ্রামে ১১৫ বিঘা জমিতে নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক ডাচ ডেইরি লিমিটেড। অস্ট্রেলিয়া থেকে ছয় বছর আগে হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের গাভি, উন্নত জাতের ভেড়া ও ছাগল দিয়ে খামারটি শুরু হয়। সেখানে এখন শুধু গরুর সংখ্যা দুই হাজারের বেশি।
বাণিজ্যিক এই খামার দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি কোরবানিসহ সারাবছর বিভিন্ন জাতের গরু পালন করছে। একই সঙ্গে দেশের বৃহৎ একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্টও স্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে ৮০০ থেকে ১ হাজার কেজি লাইভ ওয়েটের গরু নিয়ে প্রাণিসম্পদ মেলায় এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। দু’দিনব্যাপী মেলাটি গত বৃহস্পতিবার শুরু হয়ে গতকাল শুক্রবার শেষ হয়।
শত শত উদ্যোক্তা অংশ নিয়েছেন মেলায়। বিশাল আকারের মাংস উৎপাদনকারী গরু, উন্নত জাতের গাভি, ১ হাজার ২০০ কেজি ওজনের মহিষ, সিমেন উৎপাদনের কোটি টাকা দামের ষাঁড়, ছাগল, গয়াল, মহিষ, ভেড়া, উট, দুম্বা, ব্রয়লার মুরগির গ্র্যান্ট প্যারেন্ট, প্যারেন্টস স্টক, ব্রয়লার মুরগি, পোষা প্রাণী, পাখিসহ নানা পশু উঠেছে এখানে।
মেলাটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ কাউন্সিল। ৪০০ স্টলে কয়েক হাজার প্রাণীর এ প্রদর্শনী দেখতে গতকাল শত শত মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ে যায়। অনেকেই খামারগুলোতে কোরবানির গরুর বুকিং দিতে এসেছেন।
মেলায় অংশ নেওয়া খামারিরা বলেন, সরকারের সহযোগিতায় বেসরকারি খাত প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পেরেছে। এখন লক্ষ্য মাংস রপ্তানি করা। অবশ্য প্রাণির জাত উন্নয়নসহ বেশ কিছু দাবিদাওয়ার কথাও জানান তারা। অন্য দাবির মধ্যে রয়েছে পশুখাদ্যের দাম কমানো, খামারের বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক ক্যাটেগরি থেকে সরিয়ে কৃষির আওতায় আনা, উন্নত মানের ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সহজলভ্য করা এবং ডেইরি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বাস্তবায়ন করা।
মেলায় প্রাণীর পাশাপাশি প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে ব্যবহৃত ওষুধ সামগ্রী, টিকা, প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ সরঞ্জাম, মোড়কসহ পণ্য বাজারজাতকরণ প্রযুক্তির স্টলও ছিল।
কৃষক বাড়ি নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে এসেছে খামারে ব্যবহৃত নানা যন্ত্রাংশ। দুটি কঙ্করাজ জাতের গরু প্রদর্শনীতে এনেছে ওয়াকিফ এগ্রো। একেকটির ওজন ৮০০ থেকে ৯০০ কেজি। এক জোড়া গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা।
দেশের ডেইরি খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান সাদিক এগ্রো সিমেন উৎপাদনে ব্যবহৃত একটি ষাঁড় নিয়ে এসেছে, যার দাম চাওয়া হচ্ছে ১ কোটি টাকা। এ গরু ঘিরে দিনভর মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।
মেলায় দর্শনাথীদের আকর্ষণের একটি বড় জায়গা পোষা প্রাণির প্যাভিলিয়ন। কুকুর, বিড়াল, পাখিসহ নানা ধরনের পশু রয়েছে সেখানে। মেলায় বিভিন্ন জাতের পাখি প্রদর্শন করছে বার্ড ল্যান্ড। এই স্টলে মোস্তাক আহম্মেদ নামের একজন বলেন, শখ থেকে পাখি পোষা শুরু হলেও এখন তা বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে।
জিম রহমান তিনটি মুরগি প্রদর্শন করছেন এইচ অ্যান্ড আর অ্যাভিয়ারি নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে। তাঁর আমেরিকান ব্রাহামা জাতের ওই তিনটি মুরগির দাম ৬০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ও সাদিক এগ্রোর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ব্রাজিল এখন দুধ ও মাংস উৎপাদনে সবচেয়ে এগিয়ে। আমাদের দেশের মাংস উৎপাদনে উন্নত জাত পালনের অনুমতি না দিলে দেশের মাংসের খরচ কমানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ১২ কেজি দানাদার খাবার থেকে এক কেজি মাংস উৎপাদন করে দেশি জাতের গরু, যেখানে উন্নত জাতের গরুর লাগে পাঁচ কেজি খাবার।
বগুড়া ভান্ডার এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব বলেন, পশুখাদ্যের দাম গত পাঁচ বছরে ১৩৭ শতাংশ বেড়েছে। এই দাম বৃদ্ধির লাগাম টানতে হলে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার, না হলে দেশের হাজার হাজার শিক্ষিত উদ্যোক্তা পুঁজি নিয়ে ঝুঁকিতে পড়বেন।
খামারিরা বলছেন, ২০১৬ সালে কয়েকজন খামারি মিলে বাংলাদেশের গরু পালনকে শিল্পে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন বিডিএফএ। যেখানে এখন খামারির সংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশি। তাদের অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত। এই খামারিদের উদ্দীপনা ধরে রাখতে না পারলে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিডিএফএর সিনিয়র সহসভাপতি আলী আজম রহমান শিবলী বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাংসের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ছিল ৬৫ শতাংশ। পাঁচ বছরের চেষ্টায় খামারিরা ঘাটতি পূরণ করতে পেরেছেন। এখন প্রতিবছর কোরবানির ঈদে দেশের গরুতেই মিটছে চাহিদা। বরং বছর বছর ২৫ লাখের বেশি পশু উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে।
দেশে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সব ধরনের মাংসের উৎপাদন ছিল ৪৫ লাখ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ লাখ ১০ হাজার টনে। মেলার শেষদিনে ১৯ ক্যাটেগরিতে মোট ৯৩টি পুরস্কার এবং অংশগ্রহণকারীকে সনদ দেওয়া হয়েছে।