তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিএফপি’র মিডিয়া তালিকাভুক্ত ঢাকা জেলার একমাত্র স্থানীয় পত্রিকা

শিক্ষার্থী কমছে সরকারি প্রাথমিকে, বাড়ছে কিন্ডারগার্টেনে

- Advertisement -

স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বছিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয় সকাল ৮টায়। ছুটি হয় বিকেল সোয়া ৩টায়। এই স্কুলের অদূরেই অবস্থিত মর্নিং বেল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলেও একই সময়ে ক্লাস শুরু হয়ে ছুটি হয় দুপুর দেড়টায়। বছিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের স্কুলিং টাইম প্রায় পৌনে আট ঘণ্টা। মর্নিং বেলে শিশুদের থাকতে হয় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একই বয়সী শিশুদের একই কারিকুলামে স্কুলিং টাইম বা বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন দুই রকম হওয়ার কথা নয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুলিং টাইম দীর্ঘ হওয়ায় পাড়া-মহল্লার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিশুদের ভর্তির দিকে ঝুঁকছেন অভিভাবকরা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, রাজধানীতে ঋতুভেদে দুই ধরনের সময়সূচি (রুটিন) অনুসরণ করা হয়। ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকাল ৮টায় ক্লাস শুরু হয়ে বিকেল সোয়া ৩টায় বিদ্যালয় ছুটি হয়। আর মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৭টায় ক্লাস শুরু হয়ে দুপুর ২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত ক্লাস চলে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আবার দুই ধরনের বিদ্যালয় রয়েছে। দুই শিফটের বিদ্যালয়গুলোতে সকাল সাড়ে ৭টায় ক্লাস শুরু হয়ে সকাল ১০টায় প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছুটি হয়। সকাল ১০টা থেকে ১০টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত সমাবেশ হয়। সমাবেশ শেষে দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস শুরু হয়ে দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে শেষ হয়। মাঝে দুপুরে জোহরের নামাজ ও টিফিনের জন্য ৩০ মিনিটের বিরতি।

শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানান, রুটিন অনুসারে মূলত দুপুর ২টার মধ্যে শিশুদের সব ক্লাস শেষ হয়ে যায়। এর পর টানা ৪৫ মিনিট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একাংশকে বাধ্যতামূলক বসিয়ে রাখা হয় বিদ্যালয়ে। ২টা ৪৫ মিনিটে তাদের ছুটি দেওয়া হয়।

শিশুদের কেন বসিয়ে রাখা হয়– জানতে চাইলে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, মূলত এ সময়টায় রিমিডিয়াল ক্লাস (পিছিয়ে পড়া দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাস) নিতে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা আছে।

রাজধানীর যানজট ও অন্যান্য কারণে সকাল ৮টায় ক্লাস শুরু করা হলেও দেশের অন্যত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয় সকাল ৯টায়। এর পর এক শিফটের স্কুলগুলো চলে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। আর দুই শিফটের স্কুলগুলোর ক্লাস সকাল ৯টায় শুরু হয়ে চলে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত। এখানেও রিমিডিয়াল ক্লাসের নামে শিশুদের ১৫ মিনিট বিদ্যালয়ে বসিয়ে রাখা হয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সিদ্ধান্ত অনুসারে, প্রাথমিকে ক্লাস রুটিনে পিরিয়ডের সময় ঠিক রেখে স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে বিষয়ের বিন্যাস পরিবর্তন করতে পারবে। এ বছর থেকেই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে কোনো পরীক্ষা হবে না। জুন মাসের শেষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (অর্ধবার্ষিক) এবং ডিসেম্বর মাসে ধারাবাহিক মূল্যায়নের শিখন অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রণয়ন করতে হবে শিক্ষকদের। এ বছর থেকে প্রথম শ্রেণির সঙ্গে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতেও নতুন কারিকুলামে পাঠদান করা হচ্ছে। গত বছর শুধু প্রথম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের পাঠদান হয়েছে।

সারাদেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে ১ কোটি ৪২ লাখ শিশু পড়াশোনা করছে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষকের সংখ্যা চার লাখের কাছাকাছি।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর স্কুলিং টাইম কিন্ডারগার্টেনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান  বলেন, শিশু বেশিক্ষণ স্কুলে থাকলেই বেশি কিছু শিখবে, বিষয়টি এমন নয়। লক্ষ্য রাখতে হবে, শিশুর শৈশব-কৈশোর যেন কেড়ে না নেয় স্কুল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সকাল-দুপুর-বিকেল– সারাদিনই চার দেয়ালের মাঝে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস-ভূগোল বই পড়ার চাপে শিশুর খেলাধুলা শিকেয় উঠেছে। এতে শিশুরা নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যায় জেরবার। উদ্বেগে অভিভাবকরাও। নির্ধারিত বইয়ের বাইরে বাড়তি বইয়ের চাপও কোনো কোনো স্কুলে রয়েছে। এটা সঠিক নয়।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী  জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দুই ধরনের। মর্নিং শিফটের স্কুলগুলো সকাল ৮টায় শুরু হয়ে ১০টা ৪৫ মিনিটে ছুটি হয়ে যায়। আর ডে শিফটের স্কুলগুলো বেলা ১১টায় শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলে। তিনি বলেন, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীদের ক্লাস বেশির ভাগই দুপুর দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুলিং টাইম ও ক্লাস সময়সূচি ঢেলে সাজানো দরকার। নইলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দিন দিন কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসায় ঝুঁকবে। বিশেষত কওমি মাদ্রাসায় থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা থাকায় দরিদ্র পরিবারের শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। করোনাকালে স্কুল বন্ধের সুযোগে বহু শিশু মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। গণসাক্ষরতা অভিযানের এডুকেশন ওয়াচের গবেষণায়ও এ চিত্র উঠে এসেছে।

শিক্ষকরা জানান, গ্রামগঞ্জের বহু শিশু সকালে মক্তবে যায়। এর পর স্কুলে আসে। স্কুলের সময় পুনর্নির্ধারণ করা দরকার। তারা বলেন, প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহের কারণে সরকার গত ২৩ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এক সপ্তাহ স্কুল শুরুর সময় সকাল ১০টায় নির্ধারণ করেছিল। সে সময় স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বেড়ে গিয়েছিল। পুরো এক সপ্তাহের তথ্য নিলেই এর প্রমাণ পাবে সরকার।

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ একই তথ্য উল্লেখ করে বলেন, আমরা সারাদেশে সারাবছরের জন্য শ্রেণি কার্যক্রম সকাল ১০টায় শুরু করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। এতে সকালে মক্তবের ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ শেষে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রমে যথাসময়ে উপস্থিত হতে পারবে এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বাড়বে।

রুটিনে আরও যত অসংগতি

গত ২৬ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে প্রাথমিক স্তরের ক্লাস রুটিন প্রকাশ করা হয়। এটা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এক ও দুই শিফট পরিচালিত স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস সোমবার ও বুধবার। আগে সপ্তাহের প্রতিদিনই ইংরেজি ক্লাস থাকত, ২০২৪ সালের শ্রেণি রুটিনে ইংরেজির ক্লাস কমিয়ে মাত্র দু’দিন করা হয়েছে। অভিভাবকরা এর তীব্র সমালোচনা করছেন।

প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির গণিত সপ্তাহে তিন দিন (রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার)। তৃতীয় শ্রেণির ইংরেজি সোমবার ও বুধবার, চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি সপ্তাহে চার দিন (রবি, সোম, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার) এবং পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজিও সপ্তাহে চার দিন।

বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সম্পাদক স্বরূপ দাস বলেন, রুটিন সাধারণত প্রণয়ন করে থাকেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এনসিটিবি একটা নমুনা রুটিন দেয়। তারই আলোকে এবং নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর কথা ভেবে প্রধান শিক্ষক শ্রেণি রুটিন প্রণয়ন করেন। তিনি প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির জন্য ইংরেজি বিষয় রুটিনে কমপক্ষে চার দিন রাখার অনুরোধ করেন সরকারের কাছে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত শ্রেণি রুটিন করা হলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করতেও পর্যাপ্ত সময় পাবে বলে তিনি মনে করেন।

মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য

স্কুলিং টাইম ও রুটিনের সমস্যা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহম্মদ বলেন, ‘শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই স্কুলিং টাইম নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্ডারগার্টেনগুলো বরং বাড়তি বই চাপিয়ে দেয় শিশুদের ওপর। তার পরও আমরা দেখব আমাদের স্কুলিং টাইম ও রুটিনে কোথাও সমস্যা আছে কিনা। এক ও দুই শিফটের স্কুল নিয়েও ছোটখাটো কিছু সমস্যা রয়েছে। সব স্কুলকে এক শিফটে আনতে আমরা এখনও পারিনি। এসব বিষয় আমরা আরও পর্যালোচনা করে দেখব, কী করা যায়। করণীয় কিছু থাকলে আমরা তা করব।’

- Advertisement -

এ বিভাগের আরও সংবাদ